শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এনআরবিসি) ব্যাংকিং নিয়মের কোন তোয়াক্কাই করছে না। দরপত্র ছাড়াই কেনাকাটা, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কর্মকর্তা পদে অনভিজ্ঞ লোক নিয়োগ দিয়ে অভ্যন্তরীন আইন লঙ্ঘন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও নিয়মবহির্ভূতভাবে আলাদা কোম্পানি বানিয়ে নিজ ব্যাংকের সঙ্গেই ব্যবসা করছেন কোম্পানির চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে ব্যাংকটির বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। প্রতিবেদনে ব্যাংকটির এসব কর্মকান্ডকে ব্যাংকিং সুশাসনের পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা গেছে, ‘এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড’ নামে আলাদা কোম্পানি গড়ে তোলে এনআরবিসির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে ব্যাংকে গার্ড এবং পিয়নসহ বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে- লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীন নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে এনআরবিসি ব্যাংক। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বান করার বিধান থাকলেও তা মানেনি ব্যাংকটি। ফলে বিষয়টিকে ব্যাংকের সুশাসনের পরিপন্থী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ১৬ উদ্যোক্তা পরিচালকের মধ্যে ৯জনই এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোক্তা। সহযোগী প্রতিষ্ঠান না হলেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠা করে ব্যাংকটির উদ্যোক্তারা। ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) ২০১৫ সালের এক পরিপত্র অনুযায়ী, সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত কমিটিতে কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের থাকার সুযোগ নেই। ২০১৩ সালের ১১ নম্বর সার্কুলার অনুযায়ী, অনুমোদিত চাকরিবিধির আওতায় নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যাংক পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। অথচ আইনের লঙ্ঘন করে ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের পর্ষদে রয়েছেন।
ব্যাংকটিতে আইনের লঙ্ঘন করে অনভিজ্ঞ লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এনআরবিসির পর্ষদ সভার সিদ্ধান্তে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব) ফরহাদ সরকার ও মেজর (অব.) মো. পারভেজ হোসেনসহ অপর এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ফরহাদ সরকার ও পারভেজ হোসেন বর্তমানে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) পদে কর্মরত রয়েছেন। ব্যাংকটির মানবসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী এসব পদে নিয়োগের জন্য ১৩ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতার শর্ত থাকলেও তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
পর্ষদ সভায় পরিচালকদের সম্মানি বাবদ সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা অংশগ্রহণ ভাতা নির্ধারিত হলেও ভ্যাটসহ ৯ হাজার ২০০ টাকা প্রদান করা হয়েছে। মোট ১৩ পর্ষদ সভায় একই হারে ভাতা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত নিয়মের বাইরে গিয়ে পর্ষদ সভায় জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এ হিসেবে একটি পর্ষদ সভায় এনআরবিসি ব্যাংকের খরচ হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
একইভাবে পরিচালকদের সম্মানি বাবদ অংশগ্রহণ ভাতার সর্বোচ্চ সীমা ৮ হাজার টাকা নির্ধারিত থাকলেও ১৩টি সভায় পরিচালকদের ভ্যাটসহ ৯ হাজার ২০০ টাকা প্রদান করা হয়েছে।
জানতে চাইলে এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও গোলাম আউলিয়া অর্থসংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রতিবেদন করেছে সেটি অনেক আগের। এ বিষয়ে আমরা কাজও করেছি। অনেক বিষয় সমাধান করা হয়েছে। পরিচালকদের ভাতার বিষয়ে তিনি বলেন, ১০ শতাংশ ট্যাক্স কেটে রেখে পরিচালকদের পর্ষদ সভার ভাতা ৭ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আর ভ্যাটসহ এটি ৯ হাজার ২০০ টাকা হয়।
এনআরবিসি ব্যাংকের নিয়মেই আছে ব্যাংকিং সেক্টরে ১৩ বছরের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা না থাকলেও সাবেক দুই সেনা কর্মকর্তা কিভাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, আবার পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, এটি আপনাদের নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংকে অনেক সেক্টর আছে, যেসব সেক্টরে ব্যাংকিং জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছেন। এখন তারা ভালো পারফরম্যান্স করলে তো প্রমোশন পেতেই পারেন।
অর্থসংবাদ/ডব্লিওএস