শিল্পোৎপাদন ক্রমশ কমে গেছে। খুচরা বিক্রিতে পতন আরো গভীরে। উভয় খাতই অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যও সংকোচনের মুখোমুখি। সব মিলিয়ে সমাপ্ত নভেম্বরে আরো গতি হারিয়েছে চীনের অর্থনীতি। কভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং এ সম্পর্কিত লকডাউনের কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির ওপর চাপ আরো বেড়েছে।
রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, নভেম্বরে চীনের অনেক খাতের পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। রিয়েল এস্টেট খাতের মন্দা এবং বিশ্বব্যাপী দুর্বল চাহিদার মধ্যে দেশটির অর্থনীতি আরো গতি হারাতে পারে। যদিও বিরল জনবিক্ষোভের পর বেইজিং কভিডজনিত বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করেছে।
এনবিএসে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী- 'নভেম্বরে চীনের শিল্পোৎপাদন এক বছর আগের তুলনায় মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে রয়টার্সের জরিপে অর্থনীতিবিদরা ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। কারখানা উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি অক্টোবরের ৫ শতাংশের চেয়েও উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর হয়েছে। গত মাসের প্রবৃদ্ধি মে মাসের পর সবচেয়ে কম। কভিডজনিত বিধিনিষেধের কারণে গত মাসে দেশটির মূল উৎপাদন কেন্দ্র গুয়াংজু ও জেংজোর কারখানা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।'
গত মাসে চীনের খুচরা বিক্রি ৫ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে। পরিষেবা খাতে দুর্বলতার কারণেই এটি গত মে মাসের পর সবচেয়ে বড় সংকোচন।
আরও পড়ুন: ব্যাংক খাতের সংকট কোভিড বা যুদ্ধের কারণে নয়: সিপিডি
বিশ্লেষকদের ধারণা ছিলো এ সময়ে বিক্রি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কমবে। তবে গত মাসে এ খাতে পতনের হার অক্টোবরের দশমিক ৫ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে ক্যাটারিং খাতের বিক্রি এক বছর আগের তুলনায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। এ হারও অক্টোবরের ৮ দশমিক ১ শতাংশের চেয়ে বেশি। এ সময়ে গাড়ি বিক্রি বছরওয়ারি ৯ দশমিক ৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। যেখানে অক্টোবরে গাড়ি বিক্রি কমেছিল ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
গত মাসে দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পতনের হার অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসের চেয়েও বেশি। গত সপ্তাহে প্রকাশিত শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে চীনের রফতানি আয় বছরওয়ারি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। রফতানিতে এ পতন অক্টোবরের দশমিক ৩ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্লেষকরা ৩ দশমিক ৫ শতাংশ পতনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। এ সময় আমদানি ১০ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। এ হারও বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস ৬ শতাংশ সংকোচনের থেকে অনেক বেশি। অক্টোবরে বছরওয়ারি আমদানি কমার হার ছিল দশমিক ৭ শতাংশ। আমদানি-রফতানিতে পতনের কারণে দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণও কমে এসেছে। গত মাসে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৬ হাজার ৯৮৪ কোটি ডলারে নেমেছে। যেখানে অক্টোবরে রফতানি ও আমদানি বাণিজ্যের এ ব্যবধানের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৫১৫ কোটি ডলার।
সাংহাইভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গুয়োতায় জুনান সিকিউরিটিজের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাও জো জানান, বিভিন্ন খাতের দুর্বল কার্যক্রমের এ তথ্য থেকে বোঝা যায় চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নীতি আরো সহজ করা দরকার। এরই অংশ হিসেবে মধ্যমেয়াদি ঋণের সহজ সুদহার নীতি অব্যাহত রাখা হয়েছে। আগামীতে এটি আরো সহজ করা হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছি আমরা।
আরও পড়ুন: নতুন তেল-গ্যাস প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণা এইচএসবিসির
গতকাল চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতে নগদ অর্থপ্রবাহ বাড়িয়েছে এবং তারল্য পর্যাপ্ত রাখতে মধ্যমেয়াদি ঋণের সহজ সুদহার নীতি অব্যাহত রেখেছে। তবে দীর্ঘস্থায়ী জিরো কভিড নীতি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। কঠোর বিধিনিষেধে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আবাসন খাতের মন্দা, বৈশ্বিক মন্দার ঝুঁকি এবং ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো দেশটির অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
দেশটির আবাসন খাতের মন্দা পরিস্থিতিও খারাপ হয়েছে গত মাসে। এনবিএস জানিয়েছে, রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ বছরওয়ারি ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে। ২০০০ সালে বছরওয়ারি হিসাব শুরু হওয়ার পর খাতটিতে বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হলো। যদিও দেশটির নীতিনির্ধারকরা ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ, বন্ডের মাধ্যমে অর্থায়ন ও ইকুইটি ফাইন্যান্সিংসহ বিভিন্নভাবে এ খাতে সমর্থন বাড়িয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনিয়োগ ও নতুন অ্যাপার্টমেন্টের দাম এখনো নিম্নমুখী রয়েছে। সুতরাং খাতটিতে এখনো সরকারের নীতি সহায়তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।