নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের মতো এভাবে হোম ডেলিভারিতে মিলছে যে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা। তবে সব এক্সচেঞ্জ নয়, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক শ্রেণির অবৈধ এক্সচেঞ্জ। যারা প্রতিদিন লেনদেন করছে সাতশ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অভিযানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে ডলার নিয়ে অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল, অনুমোদিত ২৩৫টির বাইরে আরও সাতশটির মতো মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজারের বেশি। এসব অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জে চলছে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন। চালু করেছে হোম ডেলিভারি। অনেকে আবার হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশেও পাচার করছে বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
এক হাজারের অধিক অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০-৭৫ লাখ টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা অবৈধভাবে কেনাবেচা করে। প্রতিদিন এসব অনুমোদনহীন মানি এক্সচেঞ্জে অবৈধভাবে লেনদেন হচ্ছে সাতশ কোটি টাকারও বেশি।
সিআইডির অভিযানের কারণে অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান অফিস গুটিয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে ফোনে ফোনে যোগাযোগ করে ব্যবসা করছে। যার যেখানে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা দরকার সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। বিনিময়ে ডলার বা অন্য বিদেশি মুদ্রার ন্যায্যমূল্যের তুলনায় নিচ্ছে বেশি টাকা। এসব অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের কিছু টার্গেট কাস্টমার রয়েছে। তারা অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করছে।
মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর পাঁচটি স্থানে একযোগে তিনটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ অফিসসহ দুটি ফেরারি প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। অভিযানে গ্রেফতার হন ১৪ জন। তাদের কাছ থেকে এক কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার ৮২৬ টাকা সমমূল্যের ১৯টি দেশের মুদ্রাসহ এক কোটি ৯৯ লাখ ৬১ হাজার ৩৭৬ টাকা জব্দ করা হয়।
জানা যায়, বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এতে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্যের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের কিছু অসাধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ী অবৈধভাবে লাভবান হতে বৈদেশিক মুদ্রার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এবং অধিক মুনাফার জন্য মার্কিন ডলার মজুত করে দাম বাড়াচ্ছে। ৮৫ টাকার মার্কিন ডলার ১২৩ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এ কাজে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের যেমন ভূমিকা ছিল তেমনি কিছু কিছু বৈধ মানি এক্সচেঞ্জের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
ডলারের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় সিআইডি এরই মধ্যে বেশকিছু অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে।
সিআইডি বলছে, দেশে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পর অবৈধ মানি একচেঞ্জের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও কয়েকটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ বন্ধে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে নির্দেশনা দেয়। এদিকে হুন্ডি বন্ধে ঢাকাসহ সারা দেশে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় এরই মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকেরা। তবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও থেমে নেই তাদের ব্যবসা। শুধু রাজধানীর উত্তরা, আশকোনা, দিলকুশা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও গুলশান এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে অন্তত অর্ধশতাধিক অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা।
সিআইডি বলছে, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের একটি তালিকা তাদের দিয়েছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সিআইডি আরেকটি তালিকা তৈরি করেছে। এই দুই তালিকা ধরে সিআইডির অনুসন্ধান চলছে।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, তালিকা ধরে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সিআইডির নোটিশ পেয়ে এরই মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মালিক।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ডলার নিয়ে অস্থিরতার শুরু থেকেই সিআইডি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে। প্রথমদিকে কয়েকশ অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের তালিকা করলেও সেই তালিকা এখন বড় হয়ে হাজার ছাড়িয়েছে। তবে আমরাও নিয়মিত মনিটিং করি। গতকাল অভিযানে গ্রেফতার ১৪ জনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডির উদ্দেশ্যে নিজ হেফাজতে রাখায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হবে। পরবর্তীসময়ে তদন্ত করে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে তথ্য পেলে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে।
তিনি বলেন, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে এক হাজারের বেশি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০-৭৫ লাখ টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা অবৈধভাবে কেনাবেচা করে। প্রতিদিন এসব অনুমোদনহীন মানি এক্সচেঞ্জে অবৈধভাবে লেনদেন হচ্ছে সাতশ কোটি টাকারও বেশি। বৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে তথ্য চলে যায়।
এ বিষয়ে মানি চেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব মো. হেলাল উদ্দিন শিকদার বলেন, আমাদের ২৩৫টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বাইরে অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় এক হাজার। সেই তালিকাগুলো মানি চেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন, সিআইডি ও বিএফআইইউ বসে করা হয়েছে। অবৈধ প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতিনিয়ত বদনাম হচ্ছে আমাদের। এজন্য আমরাও জোর দাবি করি অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হোক।
তিনি বলেন, সিআইডির অভিযানের ফলে প্রায় অর্ধেক অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখন যারা রয়েছে তারা দোকান বন্ধ করে মোবাইল ফোনে হোম ডেলিভারির মতো করে বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা করছে। খোলা মার্কেটে বিক্রি করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরে ফেলবে এ কারণেই তারা গোপনে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কিছু নির্ধারিত কাস্টমার রয়েছে।
জানতে চাইলে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিচালিত অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নেপথ্যে যারাই থাক তাদের খুঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যখন কোনো কাজে, চিকিৎসায় বিদেশে যাচ্ছেন তার আগে কিছু প্রসিডিউর আছে।
‘ভিসা পাওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের যে কোনো ব্যাংকে ভিসা দেখালে বিদেশি মুদ্রা পাবেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তা দিতে বাধ্য। তাহলে কেন তারা অবৈধভাবে ১০০ টাকার ডলার ১১৫ বা ১২০ টাকায় কিনবেন। এটা অন্যায় ও অবৈধ। আমরা এ অবৈধ কাজ উৎসাহিত করতে পারি না। লাগবেই যখন তখন বৈধভাবে ব্যাংক কিংবা বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া উচিত।’
কেন অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, খুব অল্প সময়ে লাভবান হওয়া যায় তাই অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোর্স ও সিআইডির সোর্সের মাধ্যমে আমরা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযান করছি। মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু সিআইডি নয়, সব এজেন্সি মিলেই কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে আলাদ আইন আছে। সে আনুসারে কাজ করা হচ্ছে। অবৈধ মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।