নবাবি আমলে গড়ে ওঠা নাটোর রাজ্যের মহারানি ছিলেন অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানী। তিনি ছিলেন নাটোর রাজবংশের উজ্জ্বলতম চরিত্র। প্রকৃতপক্ষে রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত সমগ্র নাটোর শহরটাই মহারাণী ভবানীর। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্যই রানী ভবানীর স্মৃতি বাংলার মানুষের কাছে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
১৭৮৯ সালে ৭৪ বছর বয়সে রানী ভবানী রাজ্যশাসন থেকে অবসরে গিয়েছিলেন। কালক্রমে ইংরেজ কোম্পানি কালেক্টরেট নিয়োগের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আনে। একসময় জমিদারি প্রথাও বিলুপ্ত হয়। তবে স্বাধীনতা–পরবর্তী দেশের শাসনব্যবস্থায়ও নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।
এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রানী ভবানীর রাজ্য প্রদক্ষিণ করতে ৩৫ দিন সময় লাগত। দীর্ঘ ৫০ বছর সুশৃঙ্খলভাবে তিনি রাজ্য শাসন করেছেন। সেই রাজ্য অর্থাৎ বর্তমান নাটোর জেলাটি সাত উপজেলায় বিভক্ত হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা প্রশাসনের প্রধান পদটি সামাল দিচ্ছেন নারী।
নাটোর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হলেন সারমিনা সাত্তার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে তিনি বিসিএস দিয়ে চাকরিতে শুরু করেছেন।
এ বিষয়ে সারমিনা জানান, বাবার স্বপ্ন ছিল, তিনি একজন বড় মাপের প্রশাসক হবেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় ২০০৫ সালে তার বাবা মারা যান। পারিবারিক সিদ্ধান্তে কিছুদিনের মধ্যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রকৌশলী স্বামীর অনুপ্রেরণায় স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তবে স্নাতকোত্তর শেষ করার আগেই ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন তিনি।
রানী ভবানীকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে সারমিনা কাজ করছেন জানিয়ে বলেন, ‘রানী ভবানী খুব অল্প বয়সে এই নাটোরে বসে অর্ধবঙ্গ শাসন করে প্রজাদের মন জয় করেছেন। আমরা তার পথ অনুসরণ করে নাটোরবাসীকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
দেড় বছর আগে বড়াইগ্রাম উপজেলার ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মোসা. মারিয়াম খাতুন। তিনি বলেন, ‘প্রথমেই সবাইকে নারী দিবসের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী নানান উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই নাটোর পেয়েছে ৭ জন নারী ইউএনও। বাংলাদেশের প্রথম জেলা নাটোর, যেখানে সবগুলো উপজেলাতেই নারী ইউএনও দায়িত্ব পালন করছেন।'
রোজিনা আক্তার গত বছর নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘মায়ের অনুপ্রেরণায় প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলাম। এখন নারী বা পুরুষ নয়, বরং একজন মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয়ে অন্যের জন্য কিছু করার সুযোগ পাচ্ছি। এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা।’
নীলুফা সরকার নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন গত বছর। তিনি জানান, যোগদানের পর বাকি ছয় উপজেলায় নারী সহকর্মী পাওয়ায় তার আত্মতৃপ্তির জায়গাটা সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বিষয়ে নীলুফা বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে একটু ডানপিটে ছিলাম। চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে পছন্দ করতাম। মা–বাবার পাশাপাশি আমার নিজেরও ইচ্ছা ছিল প্রশাসনে চাকরি করব। কর্মজীবনে সেটাই হয়েছে।’
জেলার লালপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা সুলতানা। বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে যেকোনো কঠিন কাজকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে দ্বিধাবোধ করেন না। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে নারী কর্মকর্তা শব্দটাই একটা ইতিবাচক শক্তিশালী সম্ভাষণ মনে হয়। অর্পিত দায়িত্ব মায়া-মমতা দিয়ে পালন করার অসাধারণ সাধ্য রয়েছে নারী কর্মকর্তার।’
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শ্রাবণী রায়। পছন্দের প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পেয়ে তিনি এমনিতেই খুশি। কর্মস্থলের অন্য ছয়টি উপজেলায়ও নারী কর্মকর্তারা দায়িত্বে থাকায় খুশির মাত্রাটা আরও বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে তার কাছে এখন পর্যন্ত এটা শ্রেষ্ঠ কর্মস্থল।
মাহমুদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামাতে স্নাতকোত্তর করেছেন লোকপ্রশাসনে। বেশ কয়েকটি কর্মস্থল পার করে সম্প্রতি তিনি সিংড়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন। সরকারি সেবাগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্রত নিয়ে জনবান্ধব জনপ্রশাসন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন মাহমুদা।
নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহম্মেদ বলেন, ‘আমি সন্তুষ্ট এবং খুব খুশি যে, রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি মেনে জেলার সব কটি উপজেলার ইউএনওরা তাদের কর্ম ও মায়া–মমতা দিয়ে স্থানীয় জনগণের মন জয় করছেন। নারীর ক্ষমতায়নে সারা বাংলাদেশে মধ্যে নাটোর এখন রোল মডেল।’
অর্থসংবাদ/এসএম