ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক ঋণ ৯ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ওই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ছিল ১০৭ টাকা। এ হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ দাঁড়াচ্ছে ১০ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ডলারের দাম স্থিতিশীল ছিল।
ওই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। ওই দরে এখনকার বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াচ্ছে ৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। এ হিসাবে গত দেড় বছরে শুধু ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর-ছয় মাসে বৈদেশিক ঋণ ডলারের হিসাবে কমেছে। কিন্তু টাকার হিসাবে তা বেড়েছে।
সূত্র জানায়, বৈদেশিক ঋণ ডলারে নেওয়া হয়। ওইসব ডলার বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত দেশের রিজার্ভে যোগ হয়। ডলারের বিপরীতে সমপরিমাণ টাকা ব্যাংক থেকে দেওয়া হয় ঋণগ্রহীতাকে। গ্রহীতা ওইসব টাকা খরচ করেন। ঋণ পরিশোধের সময় আবার বাজার দরে ব্যাংক থেকে ডলার কিনে ঋণের কিস্তি শোধ করেন। এ কারণে ডলারের দাম বাড়লে সার্বিক ঋণের পরিমাণও বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দাম বাড়ার কারণে বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক বাড়ছে। যদিও আগের ঋণ কিছুটা পরিশোধের কারণে ডলারের হিসাবে তা কমেছে। শুধু ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারে অস্থিরতা থাকায় ঋণ পরিশোধের কোনো সুফল দেশ পেল না। উলটো ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। এজন্য ডলারের বিপরীতে টাকার মানকে স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ডলারের দাম অস্থির হলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের চাপে পড়ে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের পুরো অর্থনীতিতে। ডলারের দাম বাড়লে টাকার মান কমে যায়। হ্রাস পায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এতে বেড়ে যায় বৈদেশিক দায়-দেনা, আমদানি খরচ। বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয়। ফলে চাপ সৃষ্টি হয় মূল্যস্ফীতির ওপর। দেড় বছর ধরে যা প্রবল আকার ধারণ করেছে। মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে এখন আবার কমতে শুরু করেছে। যদিও পণ্যমূল্য বেড়েই যাচ্ছে। আবার ডলারের দাম কমে গেলে স্থানীয় মুদ্রার মান বেড়ে যায়। এতে রপ্তানি পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে। একই সঙ্গে প্রবাসীরা রেমিট্যান্সের বিপরীতে টাকা কম পান। ফলে তারা রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হন। এ কারণে ডলারের দামকে একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে ধরে রাখা হয়। ২০২১ সালের জুনের আগে ১০ বছর ধরে ডলারের দাম স্থিতিশীল ছিল। ফলে দেশকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে কোনো সংকট মোকাবিলা করতে হয়নি। এর আগে ২০০১ সালের শেষদিক থেকে ২০০২ সালের মাঝামাঝি সময় প্রবল ডলার সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছিল। তখন রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। এক কিস্তির এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ৩৯ কোটি ডলার পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। ওই অর্থ কারেন্সি সোয়াপ বা ঋণ হিসাবে নেওয়া হয়েছিল। পরের কিস্তিতে তা শোধ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৫৮৬ কোটি ডলার। ডলারের হিসাবে ২০২১ সালের জুনের তুলনায় ঋণ বেড়েছিল সাড়ে ১৭ শতাংশ। ওই সময়ে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। এ হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ বেড়েছিল ৮ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির হার ছিল সাড়ে ২৯ শতাংশ। আগের বছরের জুনের তুলনায় ডলারের দাম বেড়েছিল ৮ টাকা ৬৪ পয়সা। বৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ। ডলারের দাম বেশি মাত্রায় বাড়ায় টাকার হিসাবে ঋণ বেশি বেড়েছে। ডলারের হিসাবে বেড়েছে কম।
গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। গত বছরের জানুয়ারি-জুনের তুলনায় জুলাই-ডিসেম্বরে ছয় মাসে ঋণ কমেছে ১৮৬ কোটি ডলার। কমার হার ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ওই সময়ে ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০৭ টাকায়। ওই হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ বেড়ে হয় ১০ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। টাকার হিসাবে বেড়েছে ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ যেখানে কমেছে, সেখানে শুধু ডলারের দাম বাড়ার কারণে ঋণ বেড়ে গেছে। দেড় বছর ধরে ডলারের বাজার ছিল অস্থির। ২০২১ সালের জুনে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। এর আগে ডলারের দাম স্থিতিশীল ছিল। ফলে টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ বাড়েনি। বেড়েছে নতুন ঋণ নেওয়ার কারণে। নতুন ঋণ নেওয়ায় ডলার এসেছে। কিন্তু এখন নতুন ঋণ নেওয়া হয়নি। বরং আগের ঋণ পরিশোধ করার কারণে বৈদেশিক ঋণ কমেছে। এরপরও ডলারের দাম বাড়া এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালের জুনে ডলারের দরে এখন ঋণ হওয়ার কথা ৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। এ তুলনায় ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৭ হাজার টাকা। দেড় বছরে প্রতি ডলারে দাম বেড়েছে ২২ টাকা বা ২৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর-এই ছয় মাসে ডলারের দাম বেড়েছে ১৩ টাকা ৫৫ পয়সা। বৃদ্ধির হার সাড়ে ১৪ শতাংশ। ওই সময়ে ডলারের হিসাবে ঋণ প্রায় ২ শতাংশ কমলেও টাকার হিসাবে বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈদেশিক ঋণ নেওয়া ভালো। তবে তা ব্যবহার করতে হয় খুব সতর্কতার সঙ্গে। যে খাতে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, সেই প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করে উৎপাদনে চলে যেতে হবে। রপ্তানিমুখী শিল্পে বা ডলার আয় করা যায়-এমন প্রকল্পে ঋণ নিলে তা পরিশোধে রিজার্ভের ওপর চাপ কম পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হচ্ছে। যেগুলোর বিপরীতে কোনো ডলার আয় নেই। এজন্য ওইসব ঋণের কিস্তি শোধ করতে ব্যাংক সংকটের কারণে ডলার দিতে পারছে না। উদ্যোক্তাও ডলার আয় করতে পারছেন না। ফলে দেশের দুর্নাম ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার দিয়ে ঋণের কিস্তি শোধ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক ঋণে শৃঙ্খলা আনা উচিত। যে খাতে ঋণ নেওয়া হবে, সেই খাতেই ব্যবহার করতে হবে। দ্রুত রিটার্ন পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে ঋণ শোধ সহজ হবে। বেপরোয়াভাবে সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার কারণে এখন চাপ বেড়েছে। এটি বন্ধ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জুনে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ স্থিতি ছিল ৪ হাজার ৫৮১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। ওই সময়ে ডলারের দাম ছিল ৮০ টাকা ৬০ পয়সা। এ হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। ঋণ বেড়েছিল ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০১৮ সালের জুনে মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৫ হাজার ৬০১ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় ঋণ বেড়েছিল ২২ দশমিক ৩ শতাংশ। বিনিময় হার ছিল ৮৩ টাকা ৭৩ পয়সা। এ হিসাবে ঋণ স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। ঋণ বৃদ্ধির হার ২৭ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় ডলারের দাম বেড়েছিল ৩ টাকা ১৩ পয়সা। বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
২০১৯ সালের জুনে মোট স্থিতি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬ হাজার ২৬৩ কোটি ডলার। ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। ওই সময়ে ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা। এ হিসাবে ঋণ স্থিতি ছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা। ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় ডলারের দাম বেড়েছিল ৭৭ পয়সা। বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ।
২০২০ সালের জুনে ঋণ স্থিতি ছিল ৬ হাজার ৮৫৯ কোটি ডলার। ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ স্থিতি ছিল ৫ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ। ওই সময়ে বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। আগের বছরের তুলনায় বেড়েছিল ৪০ পয়সা। বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ।
২০২১ সালের জুনে ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮ হাজার ১৫৭ কোটি ডলারে। প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ। স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ ছিল ৬ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ওই সময়ে বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮১ পয়সা। টাকার মান বেড়েছিল ৯ পয়সা। বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ডলারে ঋণ গ্রহণ ও বিনিময় হার বাড়ার কারণে ঋণের প্রবৃদ্ধির ব্যবধান ২০১৭ সালের জুনের তুলনায় ২০১৮ সালের জুনে বেড়েছে। ২০১৯ সালের জুনে এ ব্যবধান কমে এসেছে। ২০২০ সালের জুনে এ ব্যবধান আরও কমে যায়। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সমানতালে ডলার ও টাকায় ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কারণ ওই সময়ে ডলারের দাম স্থিতিশীল ছিল। ওই বছরে টাকা ও ডলারের মানে অবমূল্যায়ন হয়নি। ২০২১ অর্থবছর থেকে এ ব্যবধান বাড়তে শুরু করে। ওই বছর শেষে তা বেড়ে টাকায় সাড়ে ২৯ শতাংশ এবং ডলারে কমে সাড়ে ১৭ শতাংশে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ডলারের হিসাবে ঋণ কম এসেছে। কিন্তু টাকার হিসাবে বেড়েছে। কারণ ওই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে।