অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে আইএমএফ যে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে সে ব্যাপারে অনেক শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। তারমধ্যে ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন-২০২১ উত্থাপনের বিষয়টিও আছে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সম্মতিও দেওয়া হয়েছে সংস্থাটিকে। সে প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদে উত্থাপনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ রোববার বলেন, নানা প্রেক্ষিতে আইনে দুর্বলতা ও ফাঁকফোকর থাকবে তবে আইনটি প্রথমে যাচাই-বাছাই করতে হবে। বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে অনেক ঘাটতি আছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ আইন যথেষ্ট নয়। এরপরও আইন থাকলে কিছুটা শাস্তি বা কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এ জন্য দরকার আইনের বাস্তবায়ন। সংশোধিত আইনে ঋণখেলাপি এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপি কিভাবে আনবে সেটিও দেখা দরকার। প্রভিশনিং বিধি, আমানতকারীদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আর্থিক নীতিগুলো আরও স্বচ্ছ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে দুজন সদস্যের পরিবর্তে ৫ জন নেওয়ার বিধান যুক্ত করে আইনটি আরও দুর্বল করা হয়েছিল। এখন সময় আসছে পরিচালকদের ভূমিকার ব্যাপারে আরও কড়াকড়ি আরোপ করার। সংশোধিত আইনে বিরাট কিছু দরকার নেই, আইনের প্রক্রিয়াগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই হবে যথেষ্ট। আর ছোট বা বড় যে পর্যায় হোক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সঠিকভাবে প্রয়োগ না হলে এ আইন দিয়ে কিছু হবে না। আমার জানামতে ব্যাংক কোম্পানি আইনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করতে সংশোধনী পর্যায়ের কার্যক্রম আন্তর্জাতিকমানের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মাধ্যমে করা হয়েছে। এখন এর সঠিক বাস্তবায়ন দরকার। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বসে নয়ছয় করার পর ধরা না হয়, সেক্ষেত্রে আইন করে কিছু হবে না। ব্যাংকের বোর্ডগুলো মানসম্পন্ন হতে হবে। পর্ষদের পরিচালকরা যেন একজন অপরজনের স্বার্থ না দেখেন। নিজ প্রতিষ্ঠানের ঋণ একজন অপরজনকে না দেন, বেনামে ঋণ দেওয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। একই পরিবার থেকে একাধিক পরিচালক হচ্ছে এসব বন্ধ করতে হবে।
সূত্রমতে, সংশোধিত আইনের খসড়ায় বলা হয়, কোনো ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালক হিসাবে অন্য কোনো ব্যাংকের পরিচালক নিযুক্ত হতে পারবেন না। তবে এটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এছাড়া ব্যাংকের পরিচালক হওয়া ব্যক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের অপর ব্যক্তি একই ব্যাংকে পরিচালক হতে পারবে না। পরিচালনা পর্ষদে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যক্তিকে পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত করা যাবে না।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্তকরণ প্রসঙ্গে খসড়া আইনে বলা আছে প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশক্রমে একটি কমিটি গঠন করবে। ওই কমিটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ শনাক্ত এবং চূড়ান্ত করবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার তালিকা প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাবে। এ তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করতে পারবে। আর চূড়ান্তভাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আপিল করতে পারবেন। তবে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। সেখানে আরও বলা হয়, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসাবে শনাক্ত হলে তার ওপর গাড়ি-বাড়ি, জমি রেজিস্ট্রেশন এবং বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এছাড়া যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলো অধিদপ্তর থেকে কোম্পানির নিবন্ধন এবং ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারবে না। এছাড়া সামাজিক, পেশাজীবী, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো পদে থাকতে পারবেন না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর সর্বোচ্চ ৫ বছরের মধ্যে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না।
আইনের খসড়ায় আরও বলা হয়েছে-কোনো ব্যাংকের পরিচালক ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে ওই ব্যাংকের পরিচালক পদ হারাবেন। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ বা অগ্রিম নিয়ে ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হলেও পরিচালকের পদ থাকবে না।
এছাড়া প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা পর্ষদের বাইরের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি অডিট কমিটি এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সমন্বয়ে একটি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করবে। আর ব্যাংকের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার স্বার্থে পরিচালনা পর্ষদ এবং পর্ষদ কমিটিগুলোর কর্মপরিধি বিষয়ে সময় সময় নির্দেশনা জারি করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। খসড়া আইনে দুর্বল ব্যাংক মার্জার করার বিধান রাখা হয়েছে।