যেসব সম্পদের জাকাত নেই
১) সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। তদ্রূপ হীরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসার পণ্য না হলে সেগুলোতেও জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবি শায়বা: ৬/৪৪৭-৪৪৮)
২) ঘরের আসবাবপত্র যেমন—খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদির জাকাত ফরজ নয়। অনুরূপ গার্হস্থ্য সামগ্রী যেমন হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়, তা যত মূল্যবানই হোকনা কেন। (মুসান্নাফে আবি শায়বা: ১০৫৬০; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭০৯৩,৭১০২;আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৬৫) তবে এক্ষেত্রে মনে রাখাতে হবে যে, যেসব বস্তুর ওপর জাকাত আসে না— সেগুলোতে যদি সোনা-রুপা সংযুক্ত থাকে, তাহলে অন্যান্য জাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে এই সংযুক্ত সোনা-রুপারও জাকাত ফরজ হবে।
৩) নিজ ও অধীনস্থ পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৪/১৯-২০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ১০২০৭; আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৬৫)
৪) পরিধেয় বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে জাকাত ফরজ হবে না। (রদ্দুল মুহতার: ২/২৬৫)
৫) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসার পণ্য নয়, তার ওপর জাকাত ফরজ নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্যদ্রব্য, ওসবের ওপর জাকাত ফরজ।
৬) ঘরবাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও (মূল দামের ওপর) জাকাত ফরজ নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ বছরে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত হয়ে নিসাব পরিমাণ হয়, তবে সেই ভাড়ার ওপর জাকাত ফরজ। বর্তমানে ঘর-বাড়ি, গাড়ি বা দোকান ভাড়া নেওয়ার সময় মোটা অঙ্কের টাকা অ্যাডভান্স রাখতে হয়, অ্যাডভান্সের এই টাকা দোকানের মালিকের হয়ে যায় না। বরং যিনি ভাড়া নিচ্ছেন, তার মালিকানায় রয়ে যায়। তাই নিসাবের পরিমাণ হলে ওই টাকাসহ জাকাত দিতে হবে। দোকান বা বাড়ি গ্রহণকারী ব্যক্তির জন্য ওই টাকার জাকাত আদায় করা জরুরি। (আদদুররুল মুখতার: ৩/১৮৪; ফতোয়ায়ে দারুল উলুম: ৬/৭৭, আহসানুল ফতোয়া: ৪/২৬১)
৭) ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরবাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী—যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালাবাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও জাকাত ফরজ নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের ওপর জাকাত আসবে।
কোন সম্পদের কত অংশ জাকাত দিতে হবে
যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের একভাগ (২.৫০%) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা, হাজারে ২৫ টাকা বা লাখে আড়াই হাজার টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় অথবা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে (আবু দাউদ: ১৫৭২; সুনানে তিরমিজি: ৬২৩)
সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক পণ্য, গবাদিপশু ও কৃষি ফসলের জাকাত
সোনা-রুপার নিসাব: সোনার নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি (তোলা)। রুপার নিসাব হলো সাড়ে বায়ান্ন ভরি (তোলা)। সোনাও রুপা উভয়টি যদি কারও কাছে থাকে এবং এর কোনোটাই নিসাব পরিমাণ না হয়; তবে উভয়টির মূল্য হিসাব করে দেখতে হবে। মূল্য যদি একত্রে রুপার নিসাব পরিমাণ হয়ে যায়, অর্থাৎ ৫২.৫ ভরি রুপার মূল্যের সমান হয়ে যায়, তবেই জাকাত আদায় করতে হবে।
নগদ টাকার নিসাব: নগদ টাকার নিসাব হলো বাজার দর হিসেবে অন্তত সাড়ে ৫২ ভরি রুপার মূল্যের পরিমাণ টাকা এক বছরকাল জমা থাকলে এর জাকাত আদায় করতে হবে। হাতে ও ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র, সিকিউরিটি, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদি নগদ অর্থ বলে গণ্য হবে।
ব্যবসায়ী পণ্যের নিসাব: ব্যবসায়ী পণ্যের নিসাব হলো কোনো জিনিস বিক্রি করার উদ্দেশ্যে রাখা হলে তাকে ব্যবসার পণ্য মনে করা হবে। সাড়ে ৫২ ভরি রুপার মূল্যের সমান মূল্যমানসম্পন্ন ব্যবসার পণ্যের জাকাত দিতে হবে। বছরান্তে তখনকার বাজারদর হিসেবে মূল্য ধরতে হবে। খরিদমূল্য ধরলে চলবে না।
কৃষি ফসলের নিসাব: কৃষি ফসলের ক্ষেত্রে প্রতিটি শ্রেণির ফসলের নিসাব পৃথকভাবে হিসাব করে নিসাব পরিমাণ ফসল হলে উশর দিতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ ধান যদি ৩০ মণ বা তার বেশি হয়, পাট যদি ৩০ মণ বা তার বেশি হয়, তাহলে ফসল তোলার সময়ই তার উশর দিতে হবে। তেমনিভাবে কলাই, সরিষা, মধু ইত্যাদি প্রতিটির নিসাব পৃথকভাবে ধরতে হবে। খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে কোনো নিসাব নেই। খনিজ সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় থাকলে সম্পদ উত্তোলনের পরই হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। খনিজ সম্পদের জাকাতের হার হচ্ছে ২০ শতাংশ।
গবাদিপশুর নিসাব: নিজের কাজে খাটে এবং বিচরণশীল বা ‘সায়েমা’ নয় এমন গরু-মহিষ বাদ দিয়ে ৩০টি হলেই তার ওপর জাকাত দিতে হবে। জাকাতের হার হবে প্রতি ৩০টির জন্য একটি এক বছর বয়সের গরু এবং প্রতি ৪০টি বা তার অংশের জন্য দুই বছর বয়সের একটি গরু। আর ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪০টি হলে একটি, ১২০টি পর্যন্ত দুটি, ৩০০টি পর্যন্ত তিনটি এবং এর ওপরে প্রতি ১০০টি ও তার অংশের জন্য আরও একটি করে ছাগল জাকাত দিতে হবে।
জাকাত দিতে হবে যাদের (জাকাতের সুনির্দিষ্ট ৮ খাত)
আল্লাহ তাআলা সম্পদশালীদের সম্পদ থেকে জাকাত সংগ্রহ করে নির্ধারিত ৮টি খাতে বণ্টন করার জন্য ইসলামি হুকুমাতকে নির্দেশ দিয়েছেন। তারা হলেন-
১. ফকির। বাংলায় তাদেরকে গরিব বলা হয়।
২. মিসকিন। যাদের আর্থিক অবস্থা গরিবদের চেয়েও খারাপ।
৩. আমেল। জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি।
৪. মন জয় করার জন্য। ইসলামের বিরোধিতা বন্ধ করা বা সহায়তার লক্ষ্যে কারও মন জয় করার প্রয়োজন হলে তাকে জাকাত দেওয়া যাবে। বর্তমানে এই খাতের খুব একটা প্রয়োজন নেই। ইসলামের শুরুর দিকে এর প্রয়োজনীয়তা ছিল। তবে নও-মুসলিমদের সমস্যা দূর করার জন্য জাকাত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করা যাবে।
৫. দাসমুক্তি। তথা দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ লোক এবং ইসলামের জন্য বন্দিদের মুক্ত করাতে তাদের জন্য জাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে।
৬. ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ। ঋণভারে জর্জরিত লোকেরা মানসিকভাবে সর্বদাই ক্লিষ্ট থাকে এবং কখনও কখনও জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের ঋণমুক্তির জন্য জাকাতের টাকা দেওয়া যাবে।
৭. আল্লাহর পথে ব্যয়। কোরআনের ভাষায় এ খাতের নাম বলা হয়েছে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’, যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর পথে। আল্লাহর পথে কথাটি খুব ব্যাপক। মুসলমানদের সব নেক কাজ আল্লাহর পথেরই কাজ।
৮. মুসাফির। মুসাফির বা প্রবাসী লোকের বাড়িতে যত ধন-সম্পত্তিই থাকুক না কেন, পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাকে জাকাত তহবিল হতে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়া যাবে।
আপন ভাই-বোন, চাচা-খালাকে জাকাত দেওয়া যাবে
ভাই-বোন দরিদ্র হলে বা জাকাত পাওয়ার যোগ্য হলে, তাদের জাকাত দেওয়া জায়েজ। বরং তাদেরকে জাকাত দেওয়া অন্য কাউকে দেওয়ার চেয়ে উত্তম। কেননা এতে সদকা ও আত্মীয়তার হক একসঙ্গে আদায় হয়। এর দলিল হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ বলেছেন— الصَّدَقَةَ في الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ وفي ذِي الرَّحِمِ صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ অর্থ: মিসকিনকে জাকাত দেওয়া সদকা; আর আত্মীয়কে দেওয়া সদকা ও আত্মীয়তার হক আদায়।’ (মুসনাদে আহমদ: ১৫৭৯৪ সুনানে নাসায়ি: ২৫৮২)
এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- জাকাতের টাকা তাদের দেওয়া হচ্ছে সেটি জানলে তারা মনে কষ্ট পেতে পারেন, তাই টাকা দেওয়ার সময় ভাই-বোনকে বা আত্মীয় স্বজনকে মুখে উচ্চারণ করে এটি জাকাতের টাকা—এমন বলার প্রয়োজন নেই। বরং মনে মনে নিয়ত করে জাকাতের টাকাটি তাদের হাতে খরচের টাকা হিসেবে দিয়ে দেওয়া উত্তম এবং এতে জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (হিদায়া: ১/২০৬, বাদায়ে: ২/৪৯)
যাদের জাকাত দেওয়া যাবে না
১) কাফের। ২) নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। ৩) নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের নাবালক সন্তান। ৪) বনু হাশেমের লোক। ৫) মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি—একইভাবে যত ওপরের স্তরের দিকের কাউকে জাকাত দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ যাদের মাধ্যমে দুনিয়ায় এসেছে, তাদেরসহ ওপরের স্তরের কাউকে জাকাত দেওয়া যাবে না। ৬) নিজের মাধ্যমে যারা দুনিয়ায় এসেছে, অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে ও তাদের সন্তানাদি একইভাবে তাদের সন্তানদের জাকাত দেওয়া যাবে না। ৭) স্ত্রী ও স্বামী একে অন্যকে জাকাত দিতে পারবে না। ৮) মসজিদ-মাদরাসা, পুল, রাস্তা, হাসপাতাল বানানোর কাজে ও মৃতের দাফনের কাজে জাকাতের টাকা দেওয়া যাবে না। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১৮৮, ১৮৯; তাতারখানিয়া: ৩/২০৬; আদদুররুল মুখতার: ৩/২৯৪, ২৯৫)
জাকাত গরিবের ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়া জরুরি
জাকাতের অর্থ শুধু গরিবদের ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দিলেই জাকাত আদায় হয়। সুতরাং মসজিদ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, কালভার্ট ও হাসপাতাল নির্মাণের ক্ষেত্রে জাকাতের অর্থ খরচ করা যাবে না। কারণ এসব ক্ষেত্রে জাকাতের অর্থ ব্যয় ব্যক্তিবিশেষকে মালিক বানিয়ে দেওয়া হয় না। (তাতারখানিয়া: ৩/১৯৮, ২০৮; দুররুল মুখতার: ৩/১৭১-১৭৩)
আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথ জাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।