গেল ২৪ ঘণ্টায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ মানুষ। এতে বিশ্বজুড়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি ৬৯ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। করোনা কেড়ে নিয়েছে ৮ লাখ ৮০ হাজারের বেশি প্রাণ।
বলা বাহুল্য, আক্রমণের শিকার বাংলাদেশও। তবে, করোনা ভাইরাসের বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ ঘটেছে বেশ পরে। তিন-চার মাস পরে। ততদিনে ইউরোপ, মার্কিন মুল্লুক করোনা ঝড়ে লণ্ডভণ্ড। সব মিলিয়ে সারা পৃথিবীতে করোনা সংক্রমণের শিকার প্রায় ২ কোটি ৬৯ লাখ মানুষ। ৮ লক্ষ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ মারাও গিয়েছেন। সংক্রমণের বিরাম নেই বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই। ইতোমধ্যে টিকা আবিষ্কারের দাবি করেছে রাশিয়া। তা নিয়ে বিতর্কও চলছে। ব্রিটেন, ভারত, চীনসহ আরও কয়েকটি দেশের গবেষণা সাফল্যের সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আগামী বছরের আগে টিকা সাধারণ মানুষকে দেওয়া সম্ভব হবে বলে কেউ আশা করছেন না। চ্যালেঞ্জটা বাংলাদেশের জন্য আরও ভয়ানক। কারণ বাংলাদেশের ১৭ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য টিকা পাওয়া সহজ নয়। পেলেও দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে কি না, সেটাও ভাববার বিষয়।
বিশ্বের বড় বড় মহামারী বিশেষজ্ঞরা এবং খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য ধরেই নিয়েছেন, এখনও কিছুকাল কাটাতে হবে করোনার সঙ্গে সহাবস্থানে। এই সহাবস্থানে কাটানোর কৌশল রপ্তটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। করোনা আতঙ্কে, ভয়ে সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে ঘরকুনো হয়ে বসে থাকা কিংবা হাত-পা ছুঁড়ে বিলাপের মধ্যে আপাতত সমাধান নেই। সেটা কোনওভাবেই কাম্য হতে পারে না। যদিও নতুন অচেনা এই ভাইরাসটিকে চিনতে আমাদের সময় লেগেছে। প্রথম দিকে বোঝা যায়নি লড়াইয়ের কৌশলটা ঠিক কী হবে। একাধিক পন্থা মাথায় এসেছে বিশেষজ্ঞদের। তার মধ্যে একটি লকডাউন। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরা, কিছুক্ষণ অন্তর হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা। কৌশলের এই দিকগুলি নিশ্চয় কাজে এসেছে। তবে আংশিক। বিশেষ করে লকডাউনের ক্ষমতাকে যতটা বড় বলে ভাবা হয়েছিল, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে বাস্তবে তা নয়। তাই আমাদের উচিত, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই মানুষ কত দ্রুত নিজ নিজ কাজেকর্মে ফিরতে পারেন তার চিন্তা করা। কারণ, জীবিকাকে স্তব্ধ করে দিয়ে, অর্থনীতিকে জুজুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বাঁচা যাবে না। পেটে খেলে তবেই পিঠে সইবে। ভাইরাসের আঘাত সইতে গেলে পেটের জোগাড় নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। তার মানে, সবার পকেটে প্রয়োজনমতো টাকার জোগান থাকা চাই। টাকার উৎস উৎপাদন। কেউ পণ্য উৎপাদন করেন। কিছু মানুষের উৎপাদন নানা রকমের পরিষেবা। পণ্য ও পরিষেবার যুগপৎ উৎপাদনে ফিরতে পারলেই অর্থনীতি ফের গতিশীল হয়ে উঠবে। চিকিৎসার জন্যও তো টাকা দরকার। কিন্তু অর্থনীতির চাকা না ঘুরলে চিকিৎসার খরচ আসবে কোত্থেকে।
কেউ কেউ হয়তো ভাবছিলেন, টাকা দেবে সরকার। ভাবতে হবে, সরকারের কাছে আলাদ্দীনের চেরাগ নেই যে, সরকার দেবে আর জনগণ বসে বসে খাবে। দেশের মানুষই সরকারের ভরসা। জনগণই আসলে সরকার। মানুষ সম্পদ তৈরি করার অজস্র পর্বে সরকারকে রাজস্ব দিয়ে থাকে। সরকারি কোষাগারের সব টাকা সাধারণ মানুষের দান। সেই মানুষ যদি ঘরকুনো হয়ে বসে থাকেন উৎপাদন কীভাবে হবে? মানুষ উৎপাদন না করলে কোষাগারের জমা টাকা শূন্য হতে বেশি সময় লাগবে না। তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, এ লকডাউনে ব্রিটেন তার দেশের কর্মচারীদের বেতনভাতা দিতে গিয়ে দুই ট্রিলিয়ন পাউন্ড দেনার দায়ে পড়েছে। দেশকে সেই পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেওয়া কোনও বুদ্ধিমান জাতির কাজ হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা ভীতির মধ্যেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য শ্রমঘন শিল্প চালু রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। যার ফলে পোশাক শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আশি শতাংশ হারানো ক্রয় আদেশ ফিরে এসেছে। করোনা মহামারির মধ্যেও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সর্বকালের মাইলফলক ছুঁয়েছে। লকডাউনে নগর জীবন স্থবির হলেও গ্রামীণ জনপদে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। যা ইতিবাচক। ইতোমধ্যে করোনাপরবর্তী অর্থনীতি পুনরোর্দ্ধারকারী দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
করোনা আতঙ্কে দেশের বেশিরভাগ সরকারি মেগা প্রকল্পও থমকে গিয়েছে। এ প্রকল্পগুলো চালু হলে বহু শ্রমজীবি মানুষের কর্মযজ্ঞ শুরু হবে আবার। করোনার অজুহাতে প্রকল্প থেমে থাকলে পিছিয়ে যাবে দেশ। শ্রমিকদের মজুরি এবং নানা ক্ষেত্রে মানুষের ন্যায্য প্রাপ্য আটকে রাখা যাবে না। ইতোমধ্যে প্রান্তিক মানুষের জন্য সমস্ত অনুদান দেয়ার ব্যবস্থাও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই নির্দেশ ঠিকমতো পালিত হচ্ছে কি না জানার জন্য শ্রম দপ্তরের নজরদারির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী এসব সময়োপযোগী সিদ্ধান্তগুলো প্রশংসার দাবিদার। সত্যি কথা হচ্ছে, সরকার যদি পথ দেখায়, সাহস জোগায় তবে অর্থনীতির বাকি ক্ষেত্রগুলির পক্ষেও ভয় কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।
সরকারের পাশাপাশি সব শ্রেণীপেশার মানুষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করোনায় আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই নয়, দ্বিগুণ শক্তি ও মনোবল নিয়ে অর্থনীতি পুনরোর্দ্ধারে মনোনিবেশ করাটাই আসল লড়াই।
যে লড়াইটা লড়তে সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে।
শরীফ নিজাম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, অর্থসংবাদ