প্রায় চার দশক আগে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কিছুই দেয়নি লোকসানি কোম্পানিটি। অথচ এই কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। জুট স্পিনার্স কর্তৃপক্ষও মনে করে শেয়ারদর বৃদ্ধির কোন কারণ নেই। কোম্পানিটির সচিব এ.টি.এম মোস্তফা বলছেন, কোম্পানির সব কার্যক্রম বন্ধ রাখলেও প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক লোকসান গুণতে হবে ৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ অফিসের আনুষাঙ্গিক সব খরচ বন্ধ থাকলেও বছরে ৬ কোটি টাকা সুদ হিসেবে ব্যাংকে দিতে হচ্ছে। প্রতিনিয়তই এ লোকসানের হার বেড়েই চলছে। বিনিয়োগকারীরা জুট স্পিনার্সের শেয়ার কেন কিনছে তারাই ভালো বলতে পারবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, বিএসইসির সার্ভেইল্যান্স বিভাগ কোম্পানিটির বর্তমান শেয়ারদর বৃদ্ধির বিষয়ে অনুসন্ধান করছে। আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি, এক বিও হিসাব থেকেই ৬০ হাজারের বেশি শেয়ার কেনার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে দর বাড়তে থাকে। আমরা এ বিষয়ে অনুসন্ধান করছি। কোন ধরণের অনিয়ম খুঁজে পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন কম হওয়ায় শেয়ার সংখ্যা কম। তাই অল্পতেই শেয়ারদর বৃদ্ধিতে জড়িয়ে পড়ছে বিনিয়োগকারীরা। এর আগেও কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কৃত্রিম দর বৃদ্ধির কারণে নজরদারিতে ছিল। বিএসইসি বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
এ বিষয়ে জুট স্পিনার্সের কোম্পানি সচিব এ.টি.এম মোস্তফা অর্থসংবাদকে বলেন, প্রতি বছর যে ৮ কোটি টাকা লোকসান হয়, তাঁর মধ্যে ৬ কোটি টাকাই ব্যাংকের সুদ। কোম্পানির অফিস বন্ধ রাখলেও এই ৬ কোটি টাকা ব্যাংকে দিতে হবে। কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে অপ্রকাশিত কোন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। কোম্পানির যে লোকসান আছে সেটি কাটিয়ে উঠতেই ৫০ বছর লাগবে। প্রতিবছর এখন গড়ে ৮ কোটি টাকা করে লোকসান হচ্ছে, লাভ হলেও তো আর বছরে ৮ কোটি টাকা হবে না।
জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন অর্থসংবাদকে বলেন, লোকসানি কোম্পানি হলেও যদি এমন তথ্য থাকে যে প্রতিষ্ঠান লাভে ফিরবে, এ ধরণের গোপণীয় তথ্য কারও কাছে থাকলে সে শেয়ার কিনতে পারে। আবার পেইডআপ ক্যাপিটাল কম থাকলে কারসাজি হতে পারে। কারণ একটি কথা প্রচলন আছে পেইড আপ ৩০ কোটি না হলে এটিবিতে স্থানান্তর করা হবে। তবে পেইড আপ ক্যাপিটাল বাড়াতে হলে আইন অনুযায়ী কোম্পানির রিজার্ভ থাকা লাগবে, আয় থাকা লাগবে এবং লভ্যাংশ দিতে হবে। দিন শেষে তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন, যিনি বিনিয়োগ করবেন।
জানা গেছে, গত ১৮ এপ্রিল লোকসানি জুট স্পিনার্সের শেয়ারদর ছিল ২১৪ টাকা ৪০ পয়সা। ২৫ মে শেয়ারটি সর্বশেষ লেনদেন হয় ৪৪৫ টাকা ৯০ পয়সায়। মাত্র ২২ কার্যদিবসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারদর ২৩১ টাকা ৫০ পয়সা বেড়েছে। শতাংশ হিসেবে কোম্পানিটির শেয়ারের দর বৃদ্ধি পরিমাণ ১০৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
জুট স্পিনার্সের শেয়ারদর বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক মনে করে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। গত ১৫ই মে ডিএসই জানায়, জুট স্পিনার্সের অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হয়। তবে কোম্পানিটি ডিএসইকে জানিয়েছে, শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। অর্থাৎ কোন কারণ ছাড়াই কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়ছে।
জানা গেছে, চার দশক আগে জুট স্পিনার্স শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়ার তথ্য নেই ডিএসইতে। গত এক দশক ধরে কোম্পানিটি আয় করতে পারেনি। সর্বশেষ আয় করেছে ২০১২ সালে। ওই বছর কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ০৬ পয়সা আয় করলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোন লভ্যাংশ দেয়নি। ২০১২ সালের পর থেকে জুট স্পিনার্স আর আয় করতে পারেনি। প্রতি বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি। বছরপ্রতি ৮ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটির উৎপাদনও বন্ধ রয়েছে। যার ফলে এ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা রয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য বলছে, ২০১৩ সালে জুট স্পিনার্সের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৪৮ টাকা ১৪ পয়সা। এর পরের দুই বছরে লোকসান কমে কোম্পানিটির। ২০১৪ সালে ৪৩ টাকা ৬৪ পয়সা এবং ২০১৫ সালে ১৯ টাকা ৬৯ পয়সা করে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় প্রতিষ্ঠানটির। ২০১৬ সালে ফের লোকসান বাড়ে জুট স্পিনার্সের। ওই বছর কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয় ৪২ টাকা ১০ পয়সা। ২০২১ সালে লোকসানের (শেয়ার প্রতি) পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ টাকা ৫৯ পয়সায়। ২০২২ সালে আরও বেশি লোকসান হয় প্রতিষ্ঠানটির। সর্বশেষ বছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েচে ৪৪ টাকা ৮২ পয়সা।
এদিকে লোকসানি জুট স্পিনার্সের পরিশোধিত মূলধনের তুলনায় ঋণের পরিমাণ ২৩ গুণ বেশি। জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অপরদিকে কোম্পানির ঋণ রয়েছে ৪০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্প মেয়াদি ঋণ ৩১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বাকি ৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ।
ঋণে জর্জরিত জুট স্পিনার্সের সম্পদের মূল্যও ঋণাত্মক। ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক (নেগেটিভ) ৪৩৮ টাকা ৪২ পয়সা। ২০১৬ সালে কোম্পানিটির নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে ধারাবাহিক লোকসানের কারণে পূঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ হবে।