আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, তিন বছর ধরে জুলাই মাসে বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়ে আসছে।
২০২২ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ শতাংশ ও ২০২১ সালের জুলাইয়ে ৫ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। দেশে এখন বর্ষার ভরা মৌসুম। তবু স্বাভাবিক বৃষ্টির দেখা নেই। আষাঢ়ের মাঝামাঝি (জুনের শেষ ও জুলাইয়ের শুরুতে) কিছুদিন বেশ বৃষ্টি ঝরেছে। এরপর দিন দিন কমে এসেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন গতকাল বলেন, ‘চলতি বছর জুলাইয়ের প্রথম ২০ দিনে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। সর্বশেষ ৩০ বছরে জুলাই মাসে এত কম বৃষ্টিপাত দেখা যায়নি। এটা খুবই উদ্বেগজনক।
তিনি জানান, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকলে সেটা এই বায়ুর অক্ষ ও পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে মিশে বর্ষা মৌসুমে অনেক বৃষ্টিপাত হয়। সেই অবস্থা এখন নেই।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে বর্ষায় দুই ধরনের বৃষ্টি দেখা গেছে—স্বাভাবিক অথবা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম। স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলেও সাধারণত ১০ থেকে ৩০ শতাংশ কম দেখা গেছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালের জুলাই মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ করে কম বৃষ্টি হয়।
কিন্তু গত বছর ও চলতি বছরের জুলাইয়ে এই কমার হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে এখানে বড় করে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক তৌহিদা রশীদ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় এখন বিশ্বজুড়েই স্বীকৃত। এতে বেশ কিছু বায়ুমণ্ডলীয় প্রক্রিয়ার ধরনে (অ্যাটমস্ফেরিক সার্কুলেশন প্যাটার্ন) কিছু পরিবর্তন আসে। এখন আবার এল নিনো শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়বে ও বৃষ্টি কমে আসতে পারে। এল নিনোর প্রভাবে কিছু প্যাটার্ন সক্রিয় থাকে না। ফলে বৃষ্টিপাত কম হয়।’
তৌহিদা রশীদ বলেন, ‘এ বছর আমরা নতুন কিছু খেয়াল করছি। সাধারণত বর্ষায় যে কারণে বৃষ্টি হয়, সেটা হচ্ছে দক্ষিণের ভারত মহাসাগরের মেঘ বলয় (ক্লাউড বেল্ট) থেকে। কিন্তু এ বছর ভারতের উত্তরে একটা সাময়িক ক্লাউড বেল্ট তৈরি হয়েছে। ওখানে কিন্তু প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য সেখানে বন্যাও দেখা দিয়েছে। এটাও সার্কুলেশন প্যাটার্নের একটা পরিবর্তন।’
এই পরিবর্তনগুলোকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সেভাবে নীতি নির্ধারণ করতে হবে বলে মত দেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘এসব জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জনস্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, খরা-বন্যাসহ সব ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে। যেহেতু এটি খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে, এগুলো তাই আমাদের এখন সব সময় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। ভালোভাবে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। তা না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা কঠিন হয়ে যাবে। কেননা ভবিষ্যতে সমস্যা আরো বাড়বে, কমবে না।
এদিকে চলতি মাসের তাপমাত্রাকে এখনো অস্বাভাবিক মনে করছেন না আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বিগত বছরগুলোতে জুলাইয়ে তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রিও দেখা গেছে। ২০১৮ সালে জুলাই মাসে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯.১ ডিগ্রি ও ২০২২ সালে ৩৯ ডিগ্রি ছিল। এ বছর জুলাই মাসে এখনো তাপমাত্রা মাঝারি মাত্রা (৩৮ ডিগ্রি) পেরোয়নি। এখন পর্যন্ত মৃদু অবস্থায় আছে।
আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ বছর জুলাই মাসে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কোথাও কোথাও ১ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি থাকলেও এটাকে পুরোপুরি অস্বাভাবিক বলা যাবে না। তাপপ্রবাহ অন্যান্য বছরের জুলাই মাসেও ছিল। এখানে উদ্বেগজনক বিষয় জুলাই মাসের তাপমাত্রা নয় বরং কম বৃষ্টিপাত।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বছরের এপ্রিল থেকে চলতি মাস পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এপ্রিলে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৬.৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৪.১ শতাংশ ও গত (জুন) মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চলতি মাসের বাকি সময়ে দেশে বড় ধরনের বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে এ মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টি কম হওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ শনিবার দেশে আগের দিনের তুলনায় বৃষ্টি কিছুটা বাড়তে পারে। আজ খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তবে রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।
আগামী দুই দিন (রবি ও সোমবার) আবহাওয়ার অবস্থা কমবেশি একই থাকতে পারে। তবে মঙ্গলবার থেকে শুরু করে পরের পাঁচ দিনে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে।
গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ফেনীতে ৩৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।