শনিবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে চট্টগ্রাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স হলে বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদ ও উন্নয়ন সমন্বয়’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের চেয়ারম্যান ড. আতিউর রহমান।
সেমিনারে ড. আতিউর রহমান বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পসমূহগুলো সম্পন্ন হলে বদলে যাবে চট্টগ্রাম। তবে শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেই হবে না তা সমন্বয় করতে হবে। এই সমন্বয়ের জন্য কো-অর্ডিনেটিং টাস্কফোর্স করা যায় কি-না সেটা ভেবে দেখা দরকার। অংশগ্রহনমূলক কার্যক্রম দরকার। ফরোয়ার্ড এবং ব্যাংকওয়ার্ড লিংকেজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ডিজিটিল অবকাঠামো গড়ে তুলছে। কিন্তু ভারত এর চেয়ে আরও বেশি সমন্বয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল অবকাঠামো সমৃদ্ধ করেছে। ভারতের মতো আমাদেরও ডিজিটাল অবকাঠামো গড়তে হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল কানেক্টিভিটি সিংক্রোনাইজড করতে হবে। চট্টগ্রাম আমাদের ইঞ্জিনের মতো। শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতিতে অবদান রাখার সক্ষমতা রাখে। চট্টগ্রাম ঘিরে অনেক মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা দরকার। কোনো রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়া, এগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে চট্টগ্রামের চেহারা বদলে যাবে। দক্ষিণ এশিয়ার হাব হয়ে উঠবে। আমি মনে করে সমন্বয়ের জন্য একটি টাস্কফোর্স থাকলে ভালো। যেখানে মাল্টি স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ থাকতে পারে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উন্নয়ন সমন্বয়ে পরিচালক (গবেষণা) আব্দুল্লাহ নদভি। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম এখন কেবলি নামে বাণিজ্যিক রাজধানী, তবে আশার কথা হচ্ছে সরকার উচ্চপর্যায়ে চট্টগ্রাম নিয়ে গভীরভাবে ভাবা হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে বাণিজ্যিক রাজধানী গড়ে তোলা বাংলাদেশের অর্থনীতি জন্য খুবই জরুরি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাজেট ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে ১৮.৮৭ বিলিয়ন টাকা। যা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৩৬ শতাংশ আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মাত্র ২৮ শতাংশ ।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাওযার সুযোগ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ নিজেদের মধ্যে করে থাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে সড়কের উন্নয়নের মাধ্যে ১ দিন সময় কমানো গেলে অনেক খরচ কমে আসে। মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের গুরুত্ব বাড়িবে দেবে। ভারতে জন্য সহজ ও সাশ্রয়ী হবে বন্দরটি। মাতরবাড়ি বন্দর বাংলাদেশের জিডিপিকে ১.১৪ শতাংবৃদ্ধি করবে, এতে ৯ লাখ কর্মসংস্থান হবে। এসব কানেক্টিভিটিকে কাজে লাগাতে হলে অংশীজনদের একযোগে কাজ করা জরুরি।
সেমিনারের মূল প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়- বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চট্টগ্রাম হলো হৃদস্পন্দন। বাংলাদেশের আমদানি ৯০ শতাংশ এবং রপ্তানির ৮৫ শতাংশ হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, সেবার মান বৃদ্ধির জন্য মাস্টারপ্ল্যান করেছি, আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দর মাতারবাড়ি ২-৩ মাসের মধ্যে চালু হবে। ভারতের সেভেন সিস্টার্স ও অন্যান্য। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচন করবে। চট্টগ্রাম বন্দর সবার জন্য উন্মুক্ত, এখানে যে কোন দেশ ব্যবহার করতে পারে। আমরা সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত আছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক শিরিন আক্তার বলেন, চট্টগ্রামের সঙ্গে সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশ পথে উন্নত যোগাযোগ রয়েছে। যোগাযোগ হচ্ছে শক্তি, যা ঊন্নয়নের পুর্বশত বিবেচনা করা হয়। ভারতের হাব হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। এতে তারও উপকৃত হবে। আমি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সুযোগ গ্রহণের অনুরোধ জানাই।
বাংলাদেশ ভারত ইতিহাস-ঐতিহ্য পরিষদের সিনিয়র সহসভাপতি প্রফেসর ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, আমাদের জলাবদ্ধতা আমাদের বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। ট্রেড, ট্রানজিট এবং ট্যুরিজম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উভয় দেশ এখান থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সহজ নৌপথ এখনও অবহেলিত রয়ে গেছে। এ জন্য কোস্টাল শিপিং কানেকটিভিটি ম্যাপিং করা জরুরি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন, ব্রিটিশ আমল থেকেই চট্টগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। চট্টগ্রামের আড়াই ভাগ জায়গা দখলে রয়েছে দুটি কর্তৃপক্ষ, তারা যথাযথভাবে ব্যবহার করছে। বন্দর হচ্ছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস, আমরা একে গলাটিপে হত্যা করছি। পতেঙ্গায় যদি কোনো জাহাজ ডুবে তাহলে বন্দর অচল হয়ে যায়। মাল্টিলেভেল যোগাযোগ ব্যবস্থা করা গেলে ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যমনি হয়ে উঠবে চট্টগ্রাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম ভবিষ্যতে আঞ্চলিক হাব হিসেবে গড়ে উঠবে। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বাই লেটারাল প্রজেক্ট গ্রহণ ও ভিসা জটিলতার সমাধান জরুরি।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবীর বলেন, ‘আমরা এনআইডি শুধু পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহার করছি, ভারত আধারকার্ড হিসেবে নানামুখী ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। আমাদের এনআইডির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। এখন ইন্টারনেট ছাড়া জীবন অচল বিবেচনা করা হয়, ইন্টারনেটকে এখন মৌলিক অধিকার বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে উন্নত নেট যোগাযোগ থাকা জরুরি। কাস্টমস সিস্টেমকে আরও সহজীকরণ করা জরুরি, দীর্ঘসূত্রিতা অনেক সময় বাণিজ্যের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশ ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য দেন, চট্টগ্রাম চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি তরফদার রুহুল আমীন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদুল আলম সুজন, চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান গালফটেইনারের প্রতিনিধি জিনা সুজিত, সমুদ্র যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. আলমগীর আক্তার সর্দার, ইশাত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল হাসান সোহেল, এমকে শিপিং লাইনস এর কর্ণধার মাসুম খান, নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক প্রদীপ দাশগুপ্ত প্রমুখ। সেমিনারে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান তারিকুল ইসলাম জুয়েল।
অর্থসংবাদ/এমআই