আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য কুদরত, নিদর্শন ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। সব থেকে বড় নির্দশন পৃথিবীতে মানুষের আগমন প্রক্রিয়া। স্বাভাবিক নিয়মে মা-বাবার মাধ্যমে পৃথিবীতে সন্তানের আগমন ঘটে থাকে। কিন্তু পৃথিবীতে প্রথম মানুষের আগমনের ব্যাপারটিই বিস্ময়কর এবং আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন বহন করে। আদিপিতা আদম আলাইহিস সালামকে মা-বাবার সংস্পর্শ ছাড়া সৃষ্টি করেন। তার সঙ্গী মা হাওয়াকেও সৃষ্টি করেন মা-বাবা ছাড়া তার বাম পাঁজরের হাড় থেকে।
আদি পিতার পাঁজর থেকে আদি মাতার জন্ম
হজরত ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস এবং অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, ইবলিসকে জান্নাত থেকে বের করা হলো আর আদমকে জান্নাতে বসবাসের সুযোগ দেয়া হল। কিন্তু তিনি জান্নাতে একাকীত্ব অনুভব করতে থাকলেন। তারপর তার চোখে ঘুম নেমে এলো, তিনি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে দেখতে পেলেন যে, তার মাথার পাশে একজন নারী বসে আছেন, যাকে তার পাঁজর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? বললেন, আমি একজন নারী।
আদম বললেন, তোমাকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে? বললেন, যাতে তুমি আমার কাছে প্রশান্তি লাভ কর। তখন ফেরেশতাগণ তাকে প্রশ্ন করলেন, হে আদম! এর নাম কি? আদম বললেন, হাওয়া। তারা বলল, তাকে হাওয়া কেন নাম দেয়া হল? তিনি বললেন, কেননা তাকে জীবিত বস্তু থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ১ম খণ্ড, ২৩৫)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং তা থেকে আহার কর স্বাচ্ছন্দ্যে, তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী এবং এই গাছটির নিকটবর্তী হয়ো না, তাহলে তোমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা বাকারা, আয়াত, ৩৫)
একইভাবে আল্লাহ তায়ালা কুদরতের আরেকটি নিদর্শন ছিলো হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম। তার জন্মও মানুষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল। তিনি অন্যান্য মানব সন্তানের মতো মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নিলেও আল্লাহ তাকে মানবজাতির জন্য নিদর্শন করেছিলেন। অন্যদের মতো বাবার সংস্পর্শে তিনি মায়ের গর্ভে আসেননি। বরং কুদরতি মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাকে পৃথিবীতে পাঠান।
হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম
আল্লাহ তায়ালা চিরকুমারী পূতঃপবিত্র মারইয়াম আলাইহাস সালামের কাছে এসে হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালামকে পাঠালেন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম তার কাছে এসে বললেন, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন দূত। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে একজন পুত্র সন্তান দান করতে চান। যিনি ভবিষ্যতে নবী হবেন, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবেন এবং কোলে থাকতেই কথা বলবেন।
এ কথা শুনে পূতঃপবিত্র মারইয়াম আলাইহাস সালাম বললেন, আমার সন্তান কীভাবে হতে পারে, আমার তো বিয়েই হয়নি। কখনো কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি, আমি ব্যভিচারিণীও নই।
উত্তরে জিবরাইল আলাইহিস সালাম মারইয়াম আলাইহাস সালামকে বললেন, এটা সত্য যে, স্বামী ছাড়া নারীর সন্তান হয় না, তবে আল্লাহ তায়ালা চাইলে সন্তান জন্মের কোনো উপকরণ ছাড়াও সন্তান জন্ম হওয়া সম্ভব। তিনি এই ঘটনাকে মানুষের জন্য নিদর্শন বানাতে চান। যেমন তিনি আদম আলাইহিস সালামকে মা-বাবা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন।
হজরত মারইয়াম আলাইহাস সালাম আল্লাহর নির্দেশের কথা শুনে তা মেনে নিলেন। তখন হজরত জিবরাইল মারইয়াম আলাইহিস সালাম তার জামার কলারের মধ্যে ফুঁ দিলেন, এরপর মারইয়াম মারইয়াম আলাইহাস সালাম আল্লাহর হুকুমে গর্ভবতী হয়ে গেলেন।
নির্ধারিত সময়ের পর হজরত মারইয়াম আলাইহাস সালাম পুত্র সন্তান জন্ম দিলেন। কথিত আছে, তিনি যেখানে পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন সেই স্থানটি ছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্ব দিকের কক্ষটি। আরেক বর্ণনামতে, বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আট মাইল দূরে বাইতুলহামদ নামক স্থানে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন।
সন্তান জন্মের পর মারইয়াম আলাইহাস সালাম যখন ছেলে নিয়ে জনসম্মুখে এলেন, বনী ইসরাঈলের লোকজন তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলো, কেউ কেউ তাকে অপবাদ দেওয়া শুরু করলো। তারা মারইয়াম আলাইহাস সালামের কোলে ঈসা আলাইহিস সালামকে দেখে বলল,
‘হে মারইয়াম! তুমি তো এক অদ্ভুত কান্ড করে বসেছ। তোমার বাবা তো খারাপ লোক ছিলেন না, আর তোমার মাও কোনো অসতী নারী ছিলেন না।’
(সূরা মারইয়াম, (১৯), আয়াত, ২৭-২৮)
মায়ের কোলে হজরত ঈসা আ.-এর কথা
এই পরিস্থিতিতে মারইয়াম আলাইহিস সালাম তখন কোলের সন্তানকে ইঙ্গিতে দেখালেন। কুদরিতভাবে আল্লাহ তায়ালা দুধের শিশু ঈসা আলাইহিস সালামের মুখে কথা বলার শক্তি দিলেন। ঈসা আলাইহিস সালাম তখন নিজের মায়ের পবিত্রতা বর্ণনা করে নিজের কুদরতি জন্মের কারণ হিসেবে যা বলেছিলেন পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা তা তুলে ধরেছেন। বর্ণিত হয়েছে,
قَالَ اِنِّیۡ عَبۡدُ اللّٰہِ ۟ؕ اٰتٰنِیَ الۡکِتٰبَ وَجَعَلَنِیۡ نَبِیًّا ۙ ٣۰ وَّجَعَلَنِیۡ مُبٰرَکًا اَیۡنَ مَا کُنۡتُ ۪ وَاَوۡصٰنِیۡ بِالصَّلٰوۃِ وَالزَّکٰوۃِ مَا دُمۡتُ حَیًّا ۪ۖ ٣١ وَّبَرًّۢا بِوَالِدَتِیۡ ۫ وَلَمۡ یَجۡعَلۡنِیۡ جَبَّارًا شَقِیًّا ٣٢ وَالسَّلٰمُ عَلَیَّ یَوۡمَ وُلِدۡتُّ وَیَوۡمَ اَمُوۡتُ وَیَوۡمَ اُبۡعَثُ حَیًّا ٣٣ ذٰلِکَ عِیۡسَی ابۡنُ مَرۡیَمَ ۚ قَوۡلَ الۡحَقِّ الَّذِیۡ فِیۡہِ یَمۡتَرُوۡنَ ٣٤
(শিশুটি, ঈসা আলাইহিস সালাম) বলল, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন নামাজ ও জাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি দাম্ভিক, হতভাগ্য। আমার প্রতি শান্তি, যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি ও যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন আমি জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হব।
এই হচ্ছে মারইয়াম পুত্র ঈসা। এটাই সঠিক বক্তব্য, যে বিষয়ে লোকেরা সন্দেহ পোষণ করছে। (সূরা মারইয়াম, (১৯), আয়াত, ১৬-৩৪, তাফসিরে ইবনে কাসির, ১৪-খণ্ড, ১৪৬)