ল্যানসেটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সিনোফার্ম বলেছে, ছয় শতাধিক সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ককে বিবিআইবিপি নামের এ ভ্যাকসিন দেয়া হয়। তাদের কারো মধ্যেই বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবীকে ভ্যাকসিনের দুই ডোজ করে দেয়া হয়। দেখা গেছে, এতে তাদের শরীরে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।
সিনোফার্মের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম দুই ধাপের ফলাফল গত বৃহস্পতিবার মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে। বায়োপিক কোম্পানি ফাইজার ও তার জার্মান সহযোগীর যৌথভাবে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলকে অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল বলে বর্ণনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এর পর পরই চীনা প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিনের ব্যাপারেও আশাব্যঞ্জক ফলাফলের কথা জানানো হলো।
বিবিআইবিপি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপটি সম্পন্ন হয় ১৯২ জন স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে। এ ধাপে ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কিনা তা যাচাই করা হয়। এ স্বেচ্ছাসেবীদের অর্ধেকের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৫৯ বছর আর বাকি অর্ধেকের ৬০ থেকে ৮০। ১৪৪ জনকে ভ্যাকসিন দেয়া হয় আর বাকি ৪৮ জনকে দেয়া হয় প্ল্যাসিবো বা ডামি। এরপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার রেকর্ড রাখা হয়। ২৮ দিনের পর্যবেক্ষণে উল্লেখযোগ্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে সিনোফার্ম।
তাত্ত্বিকভাবে ধরে নেয়া যায়, এ ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে নভেল করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা পাওয়া যাবে। তা না হলেও অন্তত তাদের ব্যাপকভাবে করোনা আক্রান্ত হওয়া ও গুরুতর পরিস্থিতি থেকে বাঁচিয়ে দেবে। যদিও বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ দেননি। তাছাড়া এ চীনা ভ্যাকসিন ১ হাজার জনের কম স্বেচ্ছাসেবীর মধ্যে প্রয়োগ করা হয়েছে।
কভিড-১৯ মহামারীর অবসান ঘটাতে এখন একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করা হচ্ছে। কারণ লকডাউন বা অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি আরোপ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের চলাফেরায় যেভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হচ্ছে, তাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে।
দুঃখের বিষয় এখনো কোনো ভ্যাকসিন নিঃসন্দেহে কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। ফলে ইউরোপে দ্বিতীয় ধাক্কায় আবার সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউনের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। দৈনিকই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। যদিও মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনকেই করোনার কার্যকর টিকার পথিকৃৎ ভাবা হয়েছিল। যুক্তরাজ্য সরকার এ ভ্যাকসিনের কয়েকশ কোটি ডোজের অর্ডারও দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে অদ্ভুত উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করায় ট্রায়াল স্থগিত করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য সরকার এখনো কোনো ভ্যাকসিনে এককভাবে ভরসা রাখছে না। তারা একাধিক ভ্যাকসিনের দিকে নজর রাখছে। ব্রিটেনের একাধিক মন্ত্রী সেপ্টেম্বরেই একটি ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করার ব্যাপারে চাপাচাপি করলেও সরকার বলছে, যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত হাতে না আসা পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, ২০২১ সালের আগে কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়ার আশা করা যাচ্ছে না।
এদিকে চীনের বিবিআইবিপি ভ্যাকসিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত সিনোফার্ম নিজেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো ও তৃতীয় পক্ষের কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই ফলাফল ল্যানসেটে প্রকাশ করা হলেও ভ্যাকসিনটির ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা বেশ আশাবাদী।
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ইনস্টিটিউট অব এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের অধ্যাপক লারিসা রুদেঙ্কো চীনা ভ্যাকসিনের এ ফলাফলকে ‘প্রতিশ্রুতিশীল’ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি সঙ্গে এ-ও বলেছেন যে এ ভ্যাকসিন আসলেই টি-সেলকে উজ্জীবিত করছে কিনা সেটি নিশ্চিতভাবে জানতে আরো বিস্তৃত গবেষণার দরকার আছে। টি-সেল হলো এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা। এ রক্তকোষগুলোই মূলত ভাইরাসকে ধ্বংস করে।
চীনা ভ্যাকসিনটির ব্যাপারে ইতিবাচক মন্তব্যই করেছেন ইউনিভার্সিটি অব বাথের বায়োলজি অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. অ্যান্ড্রু প্রেস্টোন। তিনিও ভ্যাকসিন তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাইক্রোবিয়াল প্যাথোজেনেসিসের একজন বিশেষজ্ঞ। ড. প্রেস্টোন বলেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের এ অগ্রগতি নিঃসন্দেহে ভালো খবর।