পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি বন্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে সমালোচনা চলছে। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে খোদ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানও কারসাজি রোধে স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। যদিও কারসাজি বন্ধে আইনগত তেমন ক্ষমতা নেই স্টক এক্সচেঞ্জের। এখন নানা সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে সাময়িক স্থগিতাদেশসহ তদন্ত ও কোম্পানি পরিদর্শনের ক্ষমতা চেয়েছে ডিএসই।
গত বুধবার এক চিঠিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) অনুমোদন ছাড়া কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে সাময়িক স্থগিত করার এমন ক্ষমতা চেয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জটি। এছাড়া আইপিওতে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি সুপারিশ দেওয়ার আগের ক্ষমতাও ফিরে পেতে চায় ডিএসই।
এ বিষয়ে ডিএসই’র পরিচালক মো. রকিবুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেন, প্রাইমারি রেগুলেটর হিসেবে যে সব ক্ষমতা থাকা দরকার তার পুরোটা ডিএসইকে ফিরিয়ে দেয়া হউক। চিঠিতে এ বিষয়গুলো বলা হয়েছে। কারন গত দশ বছরে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে অনেক ক্ষমতা কেড়ে নেয় হয়েছে। আমরা ডিলিস্টিং করতে পারি না, কেউ কারসাজি করলে লেনদেন বন্ধ করতে পারি না, তাহলে ডিএসইর কাজ টা কি? স্টক এক্সচেঞ্জের কাজ কি তাহলে? আইপিওতে আমরা মতামত দিতে পারব না! পৃথিবী জুড়ে স্টক এক্সচেঞ্জের যে ক্ষমতা থাকে ততটুকু আমাদেরকেও দেয়া হোক। তা না হলে আমরা যে স্বপ্ন দেখছি পুঁজিবাজার নিয়ে, তা বাস্তবায়ন হবে না।
২০১৫ সাল পর্যন্ত আইনের বাইরে গিয়ে অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি রোধে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে সাময়িক স্থগিতাদেশসহ কিছু পদক্ষেপ নিলেও পরবর্তী সময়ে এসইসির হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে যায়। কোনো কোম্পানির লেনদেন স্থগিত করতে হলে এসইসির পূর্বানুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়। এরপর থেকেই ডিএসই লেনদেন স্থগিতাদেশের মতো পদক্ষেপ আর নেয়নি।
এদিকে গত ৩১ অক্টোবর এক ওয়েবিনারে প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান অভিযোগ করেন, পুঁজিবাজারের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ডিএসইর সামনেই উৎপাদনহীন ও কারখানা বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে। কিন্তু ডিএসই কিছুই করছে না। সবাই দেখছে কারখানা ও উৎপাদন বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ার নিয়ে ডিএসইর ব্রোকাররা কারসাজি করছে। ডিএসইর সামনেই বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। কারা এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে এবং কারা বিক্রি করে, তা স্টক এক্সচেঞ্জ জানে। এখানে যে ম্যানিপুলেশন হচ্ছে এবং ওপেনলি হচ্ছে, লুকিয়ে কেউ করছে না। তারপরও ডিএসই কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। স্টক এক্সচেঞ্জকে শক্তিশালী হতে হবে।
লিস্টিং রেগুলেশন অনুযায়ী, কোনো শেয়ার নিয়ে কারসাজি সন্দেহ হলে ডিএসই তা নিয়ে তদন্ত করে এবং সেই তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে পাঠায়। এর বাইরে ডিএসইর করণীয় কিছু নেই। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার কমিশনের। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অ্যাকশনে যেতে এক থেকে দেড় বছর সময় নেয় কমিশন। ঘটনা এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সময় দীর্ঘ হওয়ায় তার কোনো প্রভাব বাজারে দেখা যায় না।
ডিএসইর লিস্টিং রেগুলেশনের ৪৯ ও ৫০ ধারায় সাময়িক স্থগিতাদেশ বিষয়ে যে আইন রয়েছে সেখানে বলা আছে, কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য কোম্পানি যদি প্রকাশ না করে এবং এক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের নোটিসের জবাব যদি না দেয়, অথবা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন হল্ট (সাময়িকভাবে স্থগিত) করতে পারে। এক্ষেত্রে আইন পুরোপুরি কাভার না করলেও এসইসির পরোক্ষ সম্মতিতে ২০১৫ ও ১৬ সালে ডিএসই এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। সে সময় মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়া অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি পেলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার কয়েক ঘণ্টার জন্য স্থগিত করত ডিএসই। লেনদেন পুনরায় চালুর পরও যদি অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি পায় সেক্ষেত্রে পুরো দিন অথবা কয়েক দিনের জন্য স্থগিত করা হতো।
কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপে কারসাজিতে জড়িতদের পাশাপাশি অন্যসব বিনিয়োগকারীরা আটকে যাওয়ায় সে সময় তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হল্ট ও সাসপেন্ডের মতো পদক্ষেপ থেকে ডিএসই সরে আসে। পরবর্তী সময়ে কোম্পানির লেনদেন স্থগিত করার ক্ষমতা কমিশন নিজের হাতে নিয়ে নেয়। সম্প্রতি কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য না থাকলেও স্বল্প সময়ে কয়েকগুণ দরবৃদ্ধির পর জিলবাংলার শেয়ার লেনদেন স্থগিত করে এসইসি। কিছুদিন পর স্থগিতাদেশ তুলেও নেয়।
২০১৫ সাল পর্যন্ত ডিএসইর কর্মকর্তারা তালিকাভুক্ত কোম্পানি তাৎক্ষণিক পরিদর্শন করতে পারতেন। এ বিষয়ে আইনে বিএসইসির সম্মতি নেওয়ার কোনো বিষয় উল্লেখ ছিল না। কিন্তু সে সময় একটি কোম্পানি ডিএসইর তাৎক্ষণিক পরিদর্শন নিয়ে আপত্তি তুললে আইন পরিবর্তন করে কমিশনের সম্মতি বাধ্যতামূলক করা হয়। এখন এটির পরিবর্তন চেয়েছে ডিএসই, যাতে পুঁজিবাজারের স্বার্থে যে কোনো সময়ে যে কোনো কোম্পানি পরিদর্শন করতে পারেন স্টক এক্সচেঞ্জটির কর্মকর্তারা।
লিস্টিং রেগুলেশনের ৪৯ ও ৫০ ধারার অ্যামেন্ডমেন্ট চেয়েছে ডিএসই। কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল ও প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি যদি সমর্থন না করে সেক্ষেত্রে ডিএসই সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার লেনদেন সময়ে সময়ে সাময়িকভাবে স্থগিতাদেশ দিতে পারে। একই ভাবে লেনদেন সাসপেন্ডের ক্ষেত্রেও ক্ষমতা চেয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জটি।
২০১৮ সাল পর্যন্ত ডিএসই যে কোনো আইপিওর (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) প্রসপেক্টাস পর্যালোচনার পাশাপাশি সুপারিশ করতে পারত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে সেই ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ পাঠাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে করে অনেক আইপিওতে স্টক এক্সচেঞ্জের নানা ধরনের আপত্তি সত্ত্বেও এসইসি সেগুলোর অনুমোদন দিয়েছিল। অবশ্য ডিএসইর সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও কিছু আইপিওর অনুমোদন এসইসি দিয়েছিল। ফলস্বরূপ বাজারে অনেক দুর্বল কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন দেয় এসইসি এবং তাতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়েন। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন আবার আইপিওতে সুপারিশ দেওয়ার ক্ষমতা চেয়েছে ডিএসই।
জেড/ অর্থসংবাদ