মা দিবসে মা নেই, আছে শুধু স্মৃতি

মা দিবসে মা নেই, আছে শুধু স্মৃতি

আলো নিজে কোনো ছায়া সৃষ্টি করে না। কারণ সে আলো—সে শুধু দেখায়, জাগিয়ে তোলে, প্রাণের আভায় আমাদের বিস্মিত করে। অথচ অন্ধকার ছাড়া আলোও বুঝে ওঠা যায় না। তেমনি, ভালোবাসা শুধু মিলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—বিরহেও জন্ম নেয় এক অনির্বচনীয়, গভীর ভালোবাসা।


আজ মা দিবস। চারপাশে ফুল, ছবি আর ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে মুখর চারপাশ। অথচ আমার দিনটা যেন এক অদৃশ্য নিস্তব্ধতায় মোড়ানো। কারণ আমার মা আর এই পৃথিবীতে নেই। আছেন শুধু স্মৃতি হয়ে—আর কিছু এমন অভিজ্ঞতা হয়ে, যা আজও হৃদয়ের গভীরে গাঁথা, যা কোনোদিন মুছে যাওয়ার নয়।


প্রায় ২৫ বছর আগের এক হজযাত্রা আজও আমার জীবনকে নাড়িয়ে দেয়। বাবা-মা তখন সুইডেনে থাকতেন। দু’জনই সুস্থ ছিলেন মোটামুটি, যদিও বাবার মাঝে মাঝে অ্যাজমার সমস্যা দেখা দিত। সে বছর কোরবানির ঈদের আগে তাঁরা বাংলাদেশে যান, সেখান থেকে হজের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব। আমি ছিলাম সুইডেনে, কিন্তু মন পড়ে ছিল তাঁদের সাথেই।


মক্কায় পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যেই হোটেল থেকে এক পাকিস্তানি চিকিৎসকের ফোন। জানালেন, বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন—সম্ভবত অ্যাজমার ওষুধটি সঙ্গে না নেওয়ায় শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। সুইডেন থেকে কীভাবে সাহায্য করা যায়? তিনি জানান, হজ মৌসুমে অনেক হাফেজ মক্কায় আসেন যারা তীর্থযাত্রীদের সহায়তা করেন।


আমি সঙ্গে সঙ্গে রিয়াদে থাকা আমার খালাতো ভাইয়ের ছেলে রিপনকে ফোন করি। রিপনের সহায়তায় দ্রুতই দুইজন হাফেজের ব্যবস্থা হয়, যাঁরা বাবা-মাকে হুইলচেয়ারে করে হজের প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতায় সহায়তা করেন। আমি জানতাম, বাবার কোন ওষুধ প্রয়োজন, চিকিৎসককে তা জানাতেই তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন। ধীরে ধীরে বাবা সুস্থ হয়ে উঠলেন।


সেই মুহূর্ত থেকে হোটেল ম্যানেজার, চিকিৎসক, দুই হাফেজ এবং বাবা-মার সঙ্গে আমার এক অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ তৈরি হয়। প্রতিদিন ফোনে জানতাম—আজ কী করলেন, কোথায় গেলেন, শরীর কেমন লাগছে।


উট কোরবানি, পাথর নিক্ষেপ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, চুল কাটা, মক্কা থেকে মদিনায় যাত্রা, কবর জিয়ারত—সবকিছুর প্রতিটি পর্ব যেন আমি দূর থেকেই তাঁদের পাশে থেকে অনুভব করেছিলাম। বাস্তবে ছিলাম সুইডেনে, কিন্তু হৃদয়ে, আত্মায় আমি তখন মক্কা-মদিনাতেই।


বাবা হজের নিয়মমাফিক চুল কাটালেন। মা চুল কাটাননি, কিন্তু কণ্ঠে ছিল সেই প্রশান্তির ঢেউ—যেন জানিয়ে দিলেন, ‘হজ্জ পালনে সকল রকম কাজ সম্পন্ন হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।’ সেই কণ্ঠস্বরের স্নিগ্ধতা আজও কানে বাজে।


তখনই প্রথমবারের মতো বুঝেছিলাম—ভালোবাসা মানে শুধু একসাথে পথচলা নয়, বরং হৃদয়ে হৃদয়ে গভীরভাবে যুক্ত থাকা। তখনও ভাবিনি, এই ভ্রমণ আমাদের একসাথে শেষ ভ্রমণ হবে। বহুবার তাঁদের সঙ্গে আমি ভ্রমণ করেছি। কিন্তু এই হজের যাত্রাটি ছিল একেবারে ভিন্ন—এটা ছিল শুধু শারীরিক ভ্রমণ নয়, এক আত্মিক অভিষেক।


এরপর সময় এসেছে, যখন আর কোনোদিন মা-বাবাকে একসঙ্গে নিয়ে কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। সেই হজের মতো করে আর কখনোই আমরা একসাথে মিলিত হতে পারিনি। কিছু ভ্রমণ জীবন বদলে দেয়। আর কিছু ভ্রমণ… চিরতরে বিদায় দেয়।


আজ মা দিবসে সেই মায়ের কথা মনে পড়ে, যার কণ্ঠে ছিল কাবা ঘরের প্রশান্তি, যার গলায় ছিল এক নিঃশব্দ সন্তুষ্টি—‘সব হয়েছে, আল্লাহর রহমতে।’ আজ আর মা নেই। নেই সেই চিরচেনা ফোন, চোখ, হাসি—তবু স্মৃতির আলোয় তিনি জেগে আছেন, এক অদৃশ্য দীপ্ত আলো হয়ে।


আজ আমি আর ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারি না—‘মা, তুমি কেমন আছো?’ তবে মাঝেমাঝেই আমি লিনশোপিং যাই—স্টকহোম থেকে দুই ঘণ্টার গাড়ি পথ—মায়ের কবর জিয়ারতে। সেই নীরব গোরস্থানে দাঁড়িয়ে আমি খুঁজি সেই চিঠিমুখি কণ্ঠ, যেখানে ভালোবাসা শব্দে শব্দে ফোটে। আমি ফিরে যেতে চাই সেই মুহূর্তে, যেখানে সুইডেন থেকে ফোন করে মক্কাকে ছুঁয়ে ছিলাম।


আলো যেমন শেষ হয় না, তেমনি মায়াও শেষ হয় না। তারা শুধু রূপান্তরিত হয়—ভিন্ন রূপে, ভিন্ন আলোয়। আজ মা নেই, কিন্তু তিনি আছেন আমার প্রতিটি দোয়ায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে। আর ভালোবাসা? সে তো রয়ে গেছে চিরকাল—আলো হয়ে, স্মৃতির সেই হজযাত্রা হয়ে।


লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ জন্মেছে জনগণের স্বপ্নে, কোনো পরিবারের জন্য নয়।
দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সংকটে দেশ: বন্ড মার্কেট বিকাশের প্রয়োজনীয়তা ও দিকনির্দেশনা
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সমাধান- পরকালে, নাকি বিবেকের ময়দানে?
জাতিসংঘ: পতনের ছায়া নাকি পুনর্জাগরণের আলো?
পিআর পদ্ধতি কার্যকর করতে আগে দরকার প্রশাসনিক সংস্কার
হাটে জন বিক্রি আধুনিক দাসত্বের অন্ধকার ও রাষ্ট্রীয় দায়
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দফা বনাম বাস্তবতা
নরওয়ের অভিজ্ঞতা বনাম বাংলাদেশের বাস্তবতা: জবাবদিহিহীন রাজনীতির অন্তরায়
তরুণ প্রজন্মের চোখে আজকের বাংলাদেশ গুজব, বিভ্রান্তি আর অনিশ্চয়তায় ভরা
কেন শিবিরের বিরুদ্ধে এত প্রপাগান্ডা?