যুক্তরাজ্যে টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার খবর শুনে জিম্বাবুয়ের বাসিন্দা লুইস চিঙ্গান্ডু খুশি হতে পারেননি। তিনিও আমাদের সবার মতোই ভাবছিলেন এবং ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় ছিলেন। কবে ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হবে আর মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে এই চিন্তায় ছিলেন তিনি। কিন্তু এখন অনেক মানুষের মতোই তিনি টানেলের শেষেও আলো দেখতে পাচ্ছেন না।
এটা পরিস্কার না যে কখন তার দেশ ভ্যাকসিন পাবে। তিনি বলেন, এটা এখন আশায় বসে থাকার মতো একটা ব্যাপার যে, যদি জীবনকালে ভ্যাকসিন পাই। তিনি বলেন, আমি ভয়ে আছি যে ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই আমি করোনায় আক্রান্ত হবো এবং মারা যাব। এটা অতিরঞ্জন মনে হতে পারে কিন্তু আগেও এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছেন এই নারী।
১৯৯০ সালে চিঙ্গাডু জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারেতে এইচআইভি প্রতিরোধের জন্য কাজ করেছেন। তিনি এইডসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে মরতে দেখেছেন। অথচ এই মৃত্যুমিছিল থামানোর মতো ওষুধ তখন ছিল। কিন্তু তারা বাঁচতে পারেননি কারণ ওই ওষুধ কেনার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তিনি বলেন, অবশেষে যখন ধনী ও ক্ষমতাবানরা সিদ্ধান্ত নেবেন যে, ‘এখন দরিদ্রদের বাঁচানোর সময় হয়েছে। তখন আমরা ভ্যাকসিন পাব।’
দ্য পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স নামের একটি দলের সদস্য চিঙ্গাংডু। এই দলটি অভিযোগ করছে যে, ধনী দেশগুলো বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় দেশ এবং কানাডা ভ্যাকসিন মজুদ করে রাখছে।
সরকার ও ভ্যাকসিন সংস্থাগুলোর মধ্যে লেনদেনের বিষয়ে নজর রাখা ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, কিছু দেশ তাদের জনগোষ্ঠীর প্রকৃত প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভ্যাকসিন নিচ্ছে। কানাডা তার পুরো জনগোষ্ঠীকে পাঁচবার ভ্যাকসিন দেওয়ার মত ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করেছে।
কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার আগেই এই দেশগুলো ভ্যাকসিন কেনার ঝুঁকি নিয়েছে এবং ভ্যাকসিনের উন্নয়নে অর্থ সহায়তা দিয়েছিল। চিঙ্গাডু এবং পিপলস ভ্যাকসিন বিশ্বাস করে যে এই প্রক্রিয়া অন্যায্য। তারা বলছে, অতিরিক্ত টিকাগুলো অবশ্যই ওইসব দেশকে দিয়ে দেওয়া উচিত যাদের এটা প্রয়োজন হচ্ছে।
এ পর্যন্ত ১৮৯টি দেশ কোভ্যাক্স উদ্যোগে সই করেছে। এতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং একটি আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন অ্যাডভোকেসি গ্রুপের সমর্থন রয়েছে। এটি দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে যেন তারা ওষধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি করার শক্তি পায়।
এর মধ্যে প্রায় সবগুলোই নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশ। তারা ভ্যাকসিন কিনবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত একটি তহবিলের মাধ্যমে। যুক্তরাজ্য এই তহবিলে ৫০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এই তহবিলে কোনো অনুদান দেয়নি। যে দেশগুলো আগাম ভ্যাকসিন কিনতে পারেনি তারা কোভ্যাক্সের মাধ্যমে ভ্যাকসিন কিনতে পারে। তবে তারা নিজেরা চুক্তি করলে আরও সাশ্রয়ী দামে ভ্যাকসিন পেতে পারে।
এখন পর্যন্ত কোভ্যাক্স তিনটি ভ্যাকসিন কোম্পানির সাথে আলোচনা করেছে। কিন্তু এটা একটি দেশের জনসংখ্যার প্রয়োজনের মাত্র ২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
সংঙ্কটময় সময়:
মেক্সিকো এই স্কিমের একটি বড় সমর্থক এবং এর মাধ্যমে ভ্যাকসিন কিনে নেবে এমন দেশগুলোর একটি। তবে দেশটির প্রধান ভ্যাকসিন আলোচক মার্থা দেলগাদো জানেন যে, ২০ শতাংশ টিকা মেক্সিকোর কোভিডের ক্রম বর্ধমান আক্রান্তের হার কমানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি অন্য উপায়েও ভ্যাকসিন সংগ্রহ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে বিলম্ব হলে তা জীবন ও মৃত্যুর প্রার্থক্য গড়তে সক্ষম।তিনি বলেন, ‘এই মাসগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
১৩ অক্টোবর এসব বিষয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। মার্থা দেলগাদো যা বর্ণনা করেছেন তাতে তার দলটি তিনটি ভ্যাকসিন কোম্পানির সাথে সরাসরি চুক্তি সম্পাদন করেছে। তারা ফাইজার ভ্যাকসিনের কিছু সংখ্যক ডোজ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন- এটি প্রথমবার ট্রায়ালের বাইরেই পাঠানো হয়েছিল। গত শুক্রবার মেক্সিকোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্য ভ্যাকসিন অনুমোদন করেছে এবং এটি এই মাসেই চালু হবে।
দেলগাদো বলেন, ‘মেক্সিকোতে অন্তত আমাদের কাছে ভ্যাকসিন কেনার অর্থ রয়েছে। আমি লাতিন-আমেরিকান অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোকে দেখছি যেগুলোর কাছে এই মুহুর্তে ভ্যাকসিন কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। ভ্যাকসিন প্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তাও তাদের কাছে নেই।’ অনেক দেশের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কোভ্যাক্সেই একমাত্র সমাধান।
মেক্সিকোর মতো পাকিস্তানও প্রতিটি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকের সাথে আলোচনা করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়সাল সুলতান বলেন, ‘আমরা অবশ্যই ধনী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি।’ তিনি ওই আলোচনায় পাকিস্তানের পক্ষে মূখ্য ভূমিকায় ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি যে, ছোট একটি রুটির টুকরা নিয়ে সবাই কাড়াকাড়ি করছে। প্রত্যেকেই এর একটি টুকরো চায় এবং এটা নিয়ে অবশ্যই কাড়াকাড়ি হতে চলেছে।’
তার মতে, ‘এখন পর্যন্ত আলোচনা ভালো চলছে তবে তারা এখনও ভ্যাকসিনের কোনও ডোজ সংগ্রহ করতে পারেননি। পাকিস্তানের সামর্থ্য নেই এমন একটি ভ্যাকসিনের জন্য অর্থ দেওয়ার যখন তারা জানে না যে এটা কাজ করবে কীনা।’ ডা. সুলতান বলেন, ‘এটি একটি বিলাসিতা। আমি মনে করি কেবল কয়েকটি দেশ এটি করতে পারে। আমরা যদি সঠিক জিনিস, সঠিক সংমিশ্রণ পাই তবে আমরা তা কেনার উদ্যোগ নিতে পারি। কিন্তু আমরা অন্ধ বাজি ধরে রাখতে পারি না।’