অনেক সময় দেখা যায় প্রতিষ্ঠানের সাথে দীর্ঘ দিনে গড়ে ওঠা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যায়। কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রায়ই প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনো রকম সমঝোতা ছাড়াই বর্তমান কর্মস্থল ছেড়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দেন বা নতুন ব্যবসায় যুক্ত হন। ফলে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে দীর্ঘ দিনের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নেয়, যা উভয়ের জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে।
নিজের স্বার্থকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে বেকায়দায় ফেলা যেমন অনুচিত, তেমনই বিদায়কালে একটি অনভিপ্রেত ঘটনা তৈরি করে দীর্ঘ দিনের কর্মস্থলের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করাও কাম্য নয়। অথচ চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে যদি শিষ্টাচারের বিষয়টি যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় তা হলে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।
একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক। একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কর্মকর্তাদের জরুরি সভা চলছে। সবাই বেশ আগ্রহের সাথে আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করছেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লক্ষ করলেন, সবার স্বতঃস্ফূর্ততা থাকলেও একজনের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই এবং তিনি কোনো কথাও বলছেন না। কর্তাব্যক্তি বলেই ফেললেন, কী ব্যাপার আরভি, আপনি কিছু বলছেন না কেন? আরভি অবলীলায় জবাব দিলেন, ‘স্যার, আমি তো আর বেশি দিন নেই আপনাদের সাথে’। আবার কেউ কেউ এমন আচরণ করেন অত্যাবশ্যকীয় সভায় উপস্থিত থাকার নির্দেশনা থাকলেও ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে যান সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ছাড়াই। কিছু কিছু এমন ব্যক্তি আছেন যারা বর্তমান কর্মস্থলে কোনো তথ্য না দিয়ে নতুন চাকরিতে যোগদান করে ফেলেন। পরবর্তীতে একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে ছাড়পত্রের আবেদন করেন অথচ প্রতিষ্ঠান এ অবস্থায় কী ধরনের সমস্যায় সম্মুখীন হতে পারে তা অবলীলায় ভুলে যান।
বাস্তব অভিজ্ঞতায় যা দেখি, এ ধরনের ঘটনায় দীর্ঘ দিনের সহকর্মীরা হঠাৎ অচেনা মানুষ হয়ে যায়। ২৫-৩০ বছরের তরুণ যেমন ৬০-৬৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মীর ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা। অথচ প্রতিষ্ঠান মালিকের প্রতিদিনের ভাবনায় থাকে কিভাবে সহকর্মীদের সাথে নিয়ে একটি পরিবারের সদস্যদের মতো কাজ করা যায়। তাদের মনের অবস্থা বোঝার জন্য চেষ্টা করেন খুব কাছে গিয়ে। তথ্য নেন আরো বেশি করে জানতে। দীর্ঘ দিন একসাথে কাজ করার পর যখন দেখেন, সহকর্মীদের শেষ কর্মদিবসগুলো আগের মতো স্বাভাবিক নয় তখন আশাহত হন। শেষ সময়গুলোর অবহেলা আর তাচ্ছিল্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকের জন্য কষ্টদায়ক। এ ধরনের আচরণ যে কারো জন্য অপ্রত্যাশিত। মূলত পরিপক্বতার অভাব, যথাযথ চাকরির ন্যূনতম সার্ভিস রুলস সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা, অকৃতজ্ঞতাবোধ ও স্বার্থপরতার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এমন চিত্র এটাই প্রমাণ করে যে, এ দেশে পেশাদারিত্বের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত। তবে বিব্রতকর পরিবেশ তৈরি না করে বা নিজেও বিব্রত না হয়ে কিভাবে চাকরি ছাড়া যায় তা ভাবা উচিত। ইচ্ছা থাকলে এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা যায়। খুব সন্তুষ্টচিত্তে কিন্তু এ কাজটি করা যায়। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে অনেক লেখাই আছে কিভাবে প্রফেশনাল উপায়ে চাকরি ছাড়া যায় এবং তার কৌশল!
যেমন অনেক সময়, প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী, যিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন, হঠাৎ দেখা যাচ্ছে কর্মী আগের মতো কাজ করছেন না। কাজে অনিয়মিত ও অমনোযোগী, অল্পতেই রেগে যাচ্ছেন এবং নেতিবাচক আচরণ করছেন। প্রতিষ্ঠানের বা সহকর্মীদের নিয়ে সমালোচনা করছেন, কাজের প্রচুর চাপ, বেতন- সুযোগ সুবিধা কম, প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা আরো অনেক কিছু। অথচ বর্তমান চাকরিটা পাওয়ার জন্য কত তদবির, দোয়া-মানত কত কিছুই না করেছেন এই কর্মী। আজ হয়তো বা এই কর্মীর অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেক কিছুই শিখেছে, তবে তাঁর মধ্যে যে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি, তা বলা যায়। পুরনো এই চাকরি এখন সামান্য বেতনের মনে হচ্ছে। অথচ এই চাকরির অভিজ্ঞতা পুঁজি করে প্রতিনিয়ত আরেকটু ভালো বেতন সুযোগ সুবিধার আশায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন। এক দিন হঠাৎ করে কাংক্ষিত ডাক পেয়েও যান। আনন্দে আত্মহারা, বিশ্বাসই হয় না, ভাবতে অবাক মনে হচ্ছে নতুন আরেকটি চাকরি পেয়েছেন। আগের সহকর্মীকে গেঁয়ো, অপেশাদার মনে হচ্ছে এখন। আর ভবিষ্যৎ সহকর্মীদের কথা মনে করলেই বেশ শিহরণ অনুভূত হচ্ছে। খুবই ইচ্ছা করছে এখন ইমেইল দিয়ে জানিয়ে দিতে যে আর কাজে আসতে পারবেন না বা আর কাজ করবেন না। এ ধরনের অনাকাংক্ষিত ভুল অনেকেই করেন।
একজন কর্মীর চাকরি ছাড়াতেই পারে। তবে মূল কারণগুলো হলো- বেতন, কর্মঘণ্টা, কাজের ব্যাপ্তি, ছুটি, সম্মান, মূল্যায়ন, স্বীকৃতি, কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, পারিবারিক ভবিষ্যৎ ও অন্যান্য সুবিধা প্রভৃতি। পারিশ্রমিক বা অর্থ কাজের সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অর্থ কেবল মানুষকে তাদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতা দেয় না, বরং উচ্চস্তরের চাহিদা মেটাতেও ভূমিকা রাখে। তবে এই অর্থ জটিল ও বহুমুখী ফ্যাক্টর হিসেবেও দেখা যায়। বেশির ভাগ কর্মীরা প্রায়ই উপলব্ধি করতে পারে না তাদের চাওয়া এবং প্রয়োজন কী? অনেক সময় না ভেবে আবেগে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। অনেকে পদবি ও যোগ্যতার ভারসাম্য বুঝতেও অক্ষম। বিবেচনায় আনে কেবল প্রতিষ্ঠানের সুযোগ সুবিধা ও বেতন-স্তরের বিষয়টি। অর্থকে প্রাধান্য না দিয়ে মানবীয় আচরণ এবং ক্যারিয়ারকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। কেবল অর্থের জন্য চাকরি পরিবর্তন না করে ক্যারিয়ারের জন্য পরিবর্তন হলে চাকরিতে সুখী এবং ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি আসতে পারে। একবার ক্যারিয়ার হয়ে গেলে টাকার বিষয়টি নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না, যা এমনিতে চলে আসে।
চিন্তাভাবনা আগে, তার পর সিদ্ধান্ত। চাকরি ছাড়ার আগে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা খুবই জরুরি। ম্যানেজারের সাথে যদি আপনার ইতিবাচক কাজের সম্পর্ক থাকে তবে নিঃসঙ্কোচে পরিকল্পনার কথা জানান তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তা বলা উচিত। যে কারণে চাকরি ছাড়ার কথা ভাবছেন তার সমাধানও পেতে পারেন। অফিসের পলিসি মোতাবেক চাকরি ছাড়াটাই উত্তম। প্রতিটি অফিস তার নিজস্ব প্রয়োজনেই নিয়মকানুন তৈরি করে। চাকরি ছাড়ার সময় অফিসের পলিসি জেনে করা উচিত। এতে সম্মান কমবে না, বরং বাড়বে। শেষ দিন পর্যন্ত আগের নিয়মে অফিসে আসা উচিত। যদি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাধা দেয় তা হলে ভিন্ন কথা। দেখা যায় অফিসে উপস্থিত, কিন্তু কাজে মন নেই, পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পর নোটিশ পিরিয়ডে পর্যন্ত থাকতে হয়। অথচ সেই সময় অনেকেই কোন কাজ না করে হেলাফেলা করে চলেন। অনেকে আবার অফিসেও আসে না তবে মাসের শেষে কিন্তু বেতনের আশা করে। কাজের দায়বদ্ধতা নেই ভেবে ফোনেও সহযোগিতা করতে চায় না, উল্টাপাল্টা জবাব দেয়। মনে রাখা উচিত এই চাকরিই এত দিন আপনার সঙ্গী ছিল। তাই শেষবেলায় আপনার আচরণে খারাপ ধারণা তৈরি হতে পারে- এমন কিছু না করাই ভালো। সবার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণই কাম্য। যেকোনো সময় ভবিষ্যতে বর্তমান চাকরিদাতার রেফারেন্স প্রয়োজন হতে পারে। বকেয়া আদায় সহজ হবে।ভবিষ্যতের পথ খোলা রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। যে প্রতিষ্ঠান থেকে আজ চলে যাচ্ছেন, ভবিষ্যতে আবার সেখানে বড় কোনো পদে আসার সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত রাখা বুদ্বিমানের কাজ। মনে রাখবেন, সম্পর্ক নষ্ট মানে সুযোগের একটি জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়া। আপনার অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারে এই প্রতিষ্ঠানও। এতে আপনিই লাভবান হবেন।
সুসম্পর্ক বজায় রেখে চাকরি ছাড়াটা ভদ্রতা। হঠাৎ করে সংক্ষিপ্ত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চাকরি ছাড়া মারাত্মক ভুল। প্রতিষ্ঠানের কথা ভেবে আপনার নিয়োগকর্তাকে যথেষ্ট সময় দেয়া উচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে মানসম্পন্ন পদত্যাগপত্রের ভাষা ইতিবাচক, সরল এবং পরিষ্কার হলে ভালো। এতে মৌলিক কিছু তথ্য যোগ করতে হবে। যেমন : (১) পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার এবং পদত্যাগ কার্যকারিতার তারিখ উল্লেখ করা (২) কাজের পরিধি বা প্রতিষ্ঠানভেদে অন্তত ২-৩ মাস আগে পদত্যাগপত্র জমা দেয়া। (৩) হাতের কাজ শেষ করে যাওয়া এবং সহকর্মীকে কাজ বুঝিয়ে দেয়া, যাতে প্রতিষ্ঠান বা সহকর্মীরা ঝুঁকিতে না পড়ে। প্রয়োজনে খোঁজখবর নেয়া, যেন সব কিছু ঠিকমতো চলে (৪) আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করার কারণ সংক্ষিপ্ত আকারে জানানো। (৫) যথাসম্ভব যেকোনো প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়া। মনে রাখতে হবে কেউ স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে চাইলে তাকে ৬০ দিন আগে কর্তৃপক্ষকে লিখিত নোটিশ দিতে হয়। যদি কেউ হঠাৎ চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে চান তবে বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী নোটিশ মেয়াদের মজুরির সমপরিমাণ টাকা প্রদান করতে হয়। অব্যাহতি প্রাপ্ত কর্মীকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ফাইল ও মালামাল জমা এবং বুঝিয়ে দিয়ে ছাড়পত্র নিতে হয়। তবে জেনে রাখা উচিত অগ্রিম নোটিশ দেয়ার অর্থ চাকরি থেকে অব্যাহতি নয়।
উপরিউক্ত বিষয়গুলোর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ দেয়ার জন্য পদত্যাগপত্রে অফিসের কর্মকর্তাদের প্রশংসা করা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানানো সমুচিত। পদত্যাগপত্রে যে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া দরকার; যেমন চাকরি ছাড়ার প্রকৃত কোনো কারণ উল্লেখ না করাই ভালো। যদি অস্বস্তিকর কোনো কারণে চাকরি ছাড়তে হয়, তা উল্লেখ না করাই উত্তম। এ ছাড়াও নেতিবাচক বিষয় এড়িয়ে যাওয়া উচিত। ছাড়পত্রের ভাষা অবশ্যই শোভন ও পেশাদার হতে হবে। আগ্রাসী বা অনুগ্রহ চাওয়াও বড় ভুল। পাশাপাশি কোনো বিষয়ে ব্যক্তিগত কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। চাকরি ছাড়ার সঠিক কারণটি তুলে ধরতেই হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। স্বল্পভাষায় নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে পারলে ভালো। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার আগে বারবার দেখে নেয়া উচিত।
দীর্ঘ দিনের পুরনো চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে নিজেকে এক ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে এগোতে হয়। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস যদি না থাকে রোমান্টিক সম্পর্ক ভাঙার মতো হতে পারে। এমন অনেক কর্মী আছে যারা শতভাগ নিশ্চিত নন যে তারা পুরনো কাজ ছেড়ে সঠিক কাজ করছেন কি না! তাই পুরনো কাজ বা প্রতিষ্ঠান মানে একটি আবেগের স্থান। চাকরি ছাড়ার আগে পরবর্তী প্রতিষ্ঠান এবং তার সহকর্মীদের সম্পর্কে জানুন। এই সমাজ আমাদেরই, এসব প্রতিষ্ঠানও আমাদের, দেশের মানুষের সাথে কাজ করি এবং করব। মনে রাখা উচিত পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, নীতি-নৈতিকতা আর মূল্যবোধ অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করে। আর তা না হলে আমাদের অবচেতন মনে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিশৃঙ্খলার চাদরে ঢেকে যাবে, যা অবশ্যই কারো কাম্য নয়।
লেখক : প্রফেসর সরওয়ার জাহান
উদ্যোক্তা ও টেকসই উন্নয়নকর্মী