২০১৮ সালের এদিনে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান প্রখ্যাত এ চলচ্চিত্রকার। বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বদরবারে নিয়ে যাওয়ার তৃতীয় স্তম্ভ মনে করা হয় তাকে। বাংলা চলচ্চিত্রে সত্যজিত রায়, ঋত্বিক ঘটকের সমসাময়িক মৃণাল সেন ‘রাত ভোর’ সিনেমা দিয়ে পরিচালনা জগতে পা রাখেন ১৯৫৫ সালে। এরপর ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ভুবন সোম’-এর মতো চলিচ্চত্র নির্মাণ করেন তিনি। তার আর একটি বিখ্যাত সিনেমা ‘বাইশে শ্রাবণ’। এর মাধ্যমে প্রথম আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান তিনি। তবে ১৯৬৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভুবন সোমে’-এর মাধ্যমেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতির তুঙ্গে চলে যান মৃণাল সেন। ভারতে প্যারালাল বা সমান্তরাল ছবির জনক ছিলেন তিনি।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন : ১৯২৩ সালের ১৪ মে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম মৃণাল সেনের। ফরিদপুরে থাকাকালীন তিনি সেখানেই উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করেন। হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করে তিনি কলকাতায় চলে যান। পদার্থবিদ্যা নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রাথমিক কর্ম : চল্লিশের দশকে তিনি সমাজবাদী সংস্থা ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং এর মাধ্যমে তিনি সমমনা মানুষদের কাছাকাছি আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি সাংবাদিক, ওষুধ বিপণনকারী এবং চলচ্চিত্রে শব্দকুশলী হিসেবেও কাজ করেন।
রাজনৈতিক দর্শন : আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী মৃণাল সেন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কখনও পার্টির সদস্য হননি। পরে রাষ্ট্রপতির মনোনীত সদস্য হিসেবে মৃণাল সেন ভারতের পার্লামেন্টেও গেছেন।
ছবি পরিচালনা : ১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘রাতভর’ মুক্তি পায়। এ ছবিটি বেশি সাফল্য পায়নি। তার দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নিচে’ তাকে স্থানীয় পরিচিতি এনে দেয়। তার তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। ১৯৬৯ সালে তার পরিচালিত ছবি ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়।
এ ছবিতে বিখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্ত অভিনয় করেছিলেন। এ ছবিটি অনেকের মতে মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি। তার ‘কলকাতা ট্রিলোজি’ অর্থাৎ ইন্টারভিউ (১৯৭১), ‘ক্যালকাটা’ ৭১ (১৯৭২) এবং ‘পদাতিক’ (১৯৭৩) ছবি তিনটির মাধ্যমে তিনি তৎকালীন কলকাতার অস্থির অবস্থাকে তুলে ধরেছিলেন। মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে মৃণাল সেন তুলে ধরেন তার খুবই প্রশংসিত দুটি ছবি ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) এবং ‘খারিজ’ (১৯৮২)-এর মাধ্যমে। ‘খারিজ’ ১৯৮৩ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল।
১৯৮০ সালের চলচ্চিত্র ‘আকালের সন্ধানে’। এ ছবিতে দেখান হয়েছিল একটি চলচ্চিত্র কলাকুশলী দলের একটি গ্রামে গিয়ে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ওপর চলচ্চিত্র তৈরির গল্প।
কিভাবে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের কাল্পনিক কাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই গ্রামের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে- সেটাই ছিল এ চলচ্চিত্রের সারমর্ম। ‘আকালের সন্ধানে’ ১৯৮১ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসেবে রুপার ভালুক জয় করে। মৃণাল সেনের পরবর্তীকালের ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৯২) এবং ‘অন্তরীণ’ (১৯৯৪)। তার শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’ মুক্তি পায় ২০০২ সালে।
অন্যান্য চলচ্চিত্র : তার পরিচালিত অন্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পুনশ্চ’ (১৯৬১), ‘অবশেষে’ (১৯৬৩), ‘প্রতিনিধি’ (১৯৬৪), ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫), ‘এক আধুরি কাহানী’ (১৯৭১), ‘কোরাস’ (১৯৭৪), ‘মৃগয়া’ (১৯৭৬), ‘পরশুরাম’ (১৯৭৮), ‘চালচিত্র’ (১৯৮১), ‘খান্ধার’ (১৯৮৩)।
ভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্র : মৃণাল সেন বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি, উড়িয়া ও তেলেগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৬৬ সালে উড়িয়া ভাষায় নির্মাণ করেন ‘মাতিরা মানিশা’, যা কালীন্দিচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়। ১৯৬৯-এ বনফুলের কাহিনী অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করে ‘ভুবন সোম’। ১৯৭৭ সালে প্রেম চন্দের গল্প অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় নির্মাণ করেন ‘ওকা ওরি কথা’। ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করেন ‘জেনেসিস’- যা হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি তিনটি ভাষায় তৈরি হয়।
অন্যান্য সম্মাননা : ১৯৯৩ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সম্মানসূচক ডিলিট পদকে ভূষিত করে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ সালে যথাক্রমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে একই সম্মান জানান। পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকেসহ নানাবিধ পুরস্কার রয়েছে পরিচালক মৃণাল সেনের ঝুলিতে। ২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিন তাকে গার্ড অব ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করেন।
তার চলে যাওয়া : ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই দিনে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার পরপারে পাড়ি জমান। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার ৯৫ বছর বয়স হয়েছিল।