প্রাণঘাতী করোনার ভয়াল থাবায় ঘরবন্দি সময়েও বছরজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহননের রূপ ভয়ংকরভাবে দেখা গেছে। পারিবারিক কলহ, প্রেমঘটিত জটিলতা, বেকারত্ব, নি:সঙ্গতা, মানসিক চাপ, তীব্র বিষন্নতাকে কেন্দ্র করে ২৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে ১১ জনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষার্থী। সর্বশেষ এ মিছিলে যুক্ত হন ঢাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম সিয়াম। ২৭ ডিসেম্বর সকালে ওই ছাত্রের বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন।
জানা গেছে, প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ এ সময়ে শিক্ষার্থীরা বাড়িতেই সময় কাটাচ্ছেন। এসময়ের মধ্যেও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মিছিল থামছেই না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রক্টরের কার্যালয় ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
২০১৯ সালে আত্মহত্যা করেন ৩ শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করেন ৯ শিক্ষার্থী। ২০১৭ সালে আত্মহত্যা করেন ৩ শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেন একজন। ২০১৫ সালে আত্মহত্যা করেন ৪ শিক্ষার্থী।এছাড়া ২০১৪ সালে ১ জন, ২০১২ সালে ১ জন, ২০০৭ সালে ২ জন ২০০৬ সালে ২ জন ২০০৫ সালে ২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেও আত্মহত্যা মিছিল দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শ দান দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও এডুকেশনাল এবং কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মেহজাবীন হক বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আত্মহত্যার পেছনে একসাথে অনেকগুলো কারণ কাজ করে, সুনির্দিষ্ট একটি কারণ থাকে না। যখন একাধিক কারণ একসাথে চাপ সৃষ্টি করে তখন একজন মানুষ এ ধরণের পথ বেছে নেয়।
তিনি আত্মহত্যার পেছনে মানসিকভাবে রোগাক্রান্ত, মাদকাসক্ত, হতাশা, বেকারত্ব ইত্যাদি কারণকে দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, আত্মহত্যার পেছনে পারিপার্শ্বিক অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোন ব্যক্তি যেখানে বসবাস করে, সেখানে তার সাপোর্ট সিস্টেমটা কেমন, তা জানা জরুরি। একজন মানুষ যখন মানসিকভাবে আঘাত পায় বা ব্যর্থ হয় তখন তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য পরিবার-বন্ধুদের সহমর্মিতার প্রয়োজন।
অধ্যাপক মেহজাবীন বলেন, মহামারীর কারণে সকলের ওপর মানসিক চাপটা অনেক বেশি। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শেষ হচ্ছে না, চাকরি পাচ্ছে না, বিদেশে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীরা বিদেশে যেতে পারছে না। প্রত্যেকের পরিকল্পনাগুলো আটকা পড়ে গেছে, এটার সাথে খাপ খাওয়ানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। যখন এগুলোর সাথে অন্য কারণগুলো যেমন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব ইত্যাদি যুক্ত হয় তখন তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কারণ অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা বৃদ্ধি পেলে আত্মহত্যা বৃদ্ধি পায়।
জীবনে একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করা ‘ওয়ান এ্যান ওনলি’ একটি বিষয়ই জীবনের সব, এ ধরণের চিন্তাভাবনা আত্মহত্যার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, আত্মহত্যা রোধে পরিবার-সহপাঠীরা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। একজন ব্যক্তি হঠাৎ করেই প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত নেয় না। তার পূর্বে সে কিছু আলামত বা চিহ্ন যেমন, ‘কিছুই ভাল্লাগে না, মরে গেলে ভালো হয়’ বহন করে থাকে। এমতাবস্থায় পরিবার- সহপাঠীদের উচিৎ তাকে থামিয়ে না রেখে তার ভেতরের বিষয়টি জানার চেষ্টা করা।
সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে শিক্ষার্থীরা শঙ্কিত। আর সমাজে ধর্ষণ, আত্মহত্যার ন্যায় নানান অপরাধ বাড়ছে। তাদের মতে, লকডাউনে অধিকাংশ সময় বাড়িতে বসে সময় কাটালে এরকম সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এসব রোধে পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।