এছাড়াও মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে এখানেও যথারীতি মানদণ্ডভিত্তিক নম্বর বিভাজন রাখা হয়েছে। তবে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইচ্ছা করলেই শোকজ করা ছাড়া এখন থেকে তার অধ্যস্তনের বিরুদ্ধে এসিআরে বিরূপ মন্তব্য লিখতে পারবেন না। আগে তাকে অভিযোগের বিষয়ে শোকজ নোটিশ দিতে হবে। এরপরও সংশোধন না হলে শোকজ নোটিশ যুক্ত করাসহ সুনির্দিষ্টভাবে বিরূপ মন্তব্য লিখতে হবে।
মূল্যায়নের মোট বিষয় রাখা হয়েছে যথারীতি আগের মতো ২৫টি। এর প্রত্যেকটিতে সর্বনিম্ন ১ এবং সর্বোচ্চ ৪ নম্বর। এসিআর ফরম পূরণে নানা জটিলতা এড়াতে এখন থেকে প্রতিবছর ডিসেম্বরে এসিআর সপ্তাহ পালন করবে প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর সংস্থাগুলো। নতুন এসিআর ফরমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা শনিবার বলেন, নৈতিকতা ও সততাহীন মেধা কখনো জনগণের উপকারে আসে না। এটা বরং ক্ষেত্রবিশেষ বিপজ্জনক বটে। অনেক সময় ব্যক্তিস্বার্থে কর্মকর্তারা নৈতিকতা ও সততা বিবর্জিত কাজ করে ফেলেন। সেজন্য এ বিষয় দুটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন ছকের একেবারে শীর্ষে রাখা হয়েছে। তার মতে, এসিআর ফরমে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
এছাড়াও তিনি আরও মনে করেন, এই এসিআর ফরম সত্যিকারার্থে শিষ্টের পালন এবং দুষ্টের দমনে জোরালো ভূমিকা রাখবে। যেসব বিষয় বাদ দিয়ে এসিআর ফরম করা হয়েছে, সেগুলো একেবারে গুরুত্বহীন নয়। যখন এটি করা হয়েছিল, তখনকার প্রেক্ষাপটে সঠিক ছিল। তবে নতুন করে যে গাইডলাইন করা হয়েছে, সেখানেও কোনো না কোনো ভাষায় এগুলো বহাল আছে।
সূত্র জানায়, নতুন এসিআর ফরম ৭ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হলেও যারা এর আগে পূরোনো এসিআরে কাজ করেছেন কিংবা ফরম জমা দিয়েছেন, সেগুলো গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তবে এখনো যারা দেননি, তাদের এসিআরে নতুন নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে।
সিআর শাখা-৩ এর যুগ্মসচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন স্বাক্ষরিত ২৬ পৃষ্ঠার বিশদ নীতিমালায় অনেক বিষয় নতুন করে সংযোজন ও যুগোপযোগী করা হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে কর্মকর্তা/কর্মচারীর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য মূল্যায়নে সর্বপ্রথম নৈতিকতার বিষয়টি আনা হয়েছে। এর পরের ধাপ থেকে পর্যায়ক্রমে রয়েছে সততা, শৃঙ্খলাবোধ, বিচার ও মাত্রাজ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, সহযোগিতার মনোভাব, সময়ানুবর্তিতা, নির্ভরযোগ্যতা, দায়িত্ববোধ, কাজে আগ্রহ ও মনোযোগ, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পালনে তৎপরতা, উদ্যম ও উদ্যোগ এবং সেবাগ্রহীতার সঙ্গে ব্যবহার।
এছাড়া কার্যসম্পাদনের ক্যাটাগরিতে রয়েছে পেশাগত জ্ঞান, কাজের মান, কর্তব্যনিষ্ঠা, সম্পাদিত কাজের পরিমাণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দক্ষতা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সামর্থ্য, অধীনস্তদের তদারকি ও পরিচালনার সামর্থ্য, দলগত কাজে সহযোগিতা ও নেতৃত্ব দানের সক্ষমতা, ই-নথি ও ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহ ও দক্ষতা, উদ্ভাবনী কাজে আগ্রহ ও সক্ষমতা এবং সব শেষে লেখা ও বলার ক্ষেত্রে সক্ষমতা। প্রতিটি বিষয়ের বিপরীতে ১, ২, ৩ অথবা সর্বোচ্চ ৪ নম্বর দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। প্রাপ্ত মোট নম্বরের মধ্যে ৯৫ থেকে ১০০ অসাধারণ, ৯০ থেকে ৯৪ অত্যুত্তম, ৮০ থেকে ৮৯ উত্তম, ৭০ থেকে ৭৯ চলতি মান এবং ৬৯ এর নিচে হলে চলতি মানের নিচে ধরা হবে। সাধারণত কারও বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য থাকলে প্রাপ্ত নম্বর এমন ধাপে নেমে আসে, যা একজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। এ কারণে প্রথমত পদোন্নতি না হওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
আগের এসিআর থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বুদ্ধিমত্তা, নিরাপত্তা সচেতনতা, সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক, অধীনস্তদের প্রশিক্ষণদানে আগ্রহ ও দক্ষতা এবং লিখিত ও প্রতিস্বাক্ষর ফরম পূরণে তৎপরতা। নৈতিকতা ও সততা ছাড়াও নতুন করে যুক্ত হয়েছে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে ব্যবহার, দলগত কাজে সহযোগিতা ও নেতৃত্বদানের সক্ষমতা, ই-নথি ও ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহ এবং দক্ষতা উদ্ভাবনী কাজে আগ্রহ ও সক্ষমতা। সংশোধন করা হয়েছে সহযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার মনোভাব, কাজে আগ্রহের পরিবর্তে কাজে আগ্রহ ও মনোযোগ প্রভৃতি।
বিরূপ মন্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে অনুবেদনকারী/প্রতিঅনুবেদনকারীর করণীয় সংক্রান্ত চতুর্থ অধ্যায়ের ৪.৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অনুবেদনাধীন কর্মচারীর আচরণ বা কার্যধারায় কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে অনুবেদনকারী/প্রতিস্বাক্ষরকারী কর্তৃক বিরূপ মন্তব্য প্রদানের আগে তাকে লিখিতভাবে সংশোধনের জন্য আদেশ প্রদান করতে হবে। এছাড়া যথাযথভাবে আদেশ জারিপূর্বক অনুলিপি কর্মচারীর ব্যক্তিগত নথিতে সংরক্ষণ করতে হবে এবং আবশ্যিকভাবে ডোসিয়ার সংরক্ষণকারী কর্তৃপক্ষকে অনুলিপি পাঠাতে হবে।
লিখিত আদেশের পরও সংশোধন না হলে গোপনীয় অনুবেদনে বিরূপ মন্তব্য প্রদান করা যাবে। তবে বিরূপ মন্তব্য সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হতে হবে এবং গোপনীয় অনুবেদন অনুস্বাক্ষর ও প্রতিস্বাক্ষরের সময় ইতঃপূর্বে লিখিতভাবে সতর্ক করা নোটিশের কপি আবশ্যিকভাবে সংযুক্ত করতে হবে। এছাড়া অনুবেদনকারী কর্তৃক প্রদত্ত বিরূপ মন্তব্যের বিষয়ে প্রতিস্বাক্ষরকারী একমত পোষণ না করলে কারণ উল্লেখপূর্বক মন্তব্য ও নম্বর প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিস্বাক্ষরকারীর মন্তব্য ও প্রদত্ত নম্বর চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হবে।
গোপনীয় অনুবেদন প্রাপ্যতার ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে ডোসিয়ার সংরক্ষণকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিরূপ মন্তব্য উদ্ধৃত করে আধা সরকারি (ডিও) পত্রের মাধ্যমে লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট অনুবেদনাধীন, অনুবেদনকারী ও প্রতিস্বাক্ষরকারী কর্মচারীকে জানাতে হবে।
অবসরে যাওয়ার ২ বছর পর এসিআর নথি সংরক্ষণ করা হবে না। তবে কোনো কর্মকর্তা চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর যদি জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন তবে তার এসিআর সংরক্ষণ করা হবে। প্রয়োজনে জাতীয় আর্কাইভে রাখা হবে। এছাড়া ২০১৮ সালে প্রণীত কর্মচারী আইনের সংজ্ঞা অনুসরণ করে নতুন এই ফরমে কর্মকর্তা শব্দটির পরিবর্তে কর্মচারী রাখা হয়েছে। কর্মচারী শব্দের দ্বারা সরকারি চাকরির সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বোঝাবে।
ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী সব প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং ডোসিয়ার সংরক্ষণকারী অন্য সব দপ্তর/সংস্থা প্রতিবছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘গোপনীয় অনুবেদন সপ্তাহ’ পালন করবে। এ সময় গোপনীয় অনুবেদনবিষয়ক ‘হেল্প ডেস্ক’ স্থাপন করে তথ্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দপ্তর/সংস্থার অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্যে গোপনীয় অনুবেদনবিষয়ক ২ ঘণ্টার প্রশিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, একমাত্র প্রথম গ্রেডে থাকা কর্মকর্তা ছাড়া ২ থেকে ১৯ গ্রেড পর্যন্ত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিজীবনে এসিআর নিতে হয়। বিশেষত পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে এটি মূল্যায়ন করা হয়।