বৃহত্তম দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনা ট্রাম্প প্রশাসনের আগে থেকে শুরু হলেও প্রযুক্তি সংস্থাগুলোয় অভূতপূর্ব শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মাধ্যমে বিরোধকে আরো তীব্র করেছিলেন ট্রাম্প। তবে তিনি যেমনটা আশা করেছিলেন তেমন ফল ফলেনি। কোন নীতি কাজ করেছে আর কোনটি করেনি, সেই নীলনকশা উত্তরসূরি জো বাইডেনের কাছে রেখে যাচ্ছেন তিনি।
নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মেরি লাভলি বলেন, চীন বিশ্ব অর্থনীতির একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। আপনি চাইলেই তাকে কাগজের পুতুলের মতো টুকরো টুকরো করতে পারবেন না।
২০১৬ সালের নির্বাচনী বছরে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনবেন। এক্ষেত্রে তিনি মূলধারার অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ তেমন পাত্তা দেননি। অথচ মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে চীনের সঙ্গে ঘাটতি আরো বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। গত বছরের নভেম্বর নাগাদ ১১ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।
২০১৯ সালে অবশ্য চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছিল। চীনের পরিবর্তে মার্কিন সংস্থাগুলো আমদানির জন্য ভিয়েতনামের মতো দেশকে বেছে নিয়েছিল। তবুও বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ২০১৬ সালে ২৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের চেয়ে বেশি ছিল। এক্ষেত্রে আংশিক কারণ ছিল পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে বেইজিংয়েরও প্রায় ১১ হাজার ডলার মূল্যমানের মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা। ফলে মার্কিন পণ্যগুলোর আমদানি কমে যায় এবং এটি গত বছরের শেষ কয়েক মাসে এসে পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছে।
এক বছর আগে স্বাক্ষরিত প্রথম ধাপের বাণিজ্য চুক্তির অংশ হিসেবে বেইজিং ২০২০ সালে সুনির্দিষ্ট বিভাগে ১৭ হাজার ২০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানির উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বছর শেষে দেখা যায়, এ লক্ষ্যমাত্রার কেবল ৫১ শতাংশ আমদানি করে বেইজিং। যদিও মহামারীর কারণে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া এবং বোয়িংয়ের উড়োজাহাজে সমস্যাগুলো এ ব্যর্থতায় ভূমিকা রেখেছিল।
এদিকে মহামারী দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলো চীনের বিশাল ম্যানুফ্যাকচারিং সক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। মহামারীতে কম্পিউটার ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মতো পণ্যগুলোর তীব্র চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বাড়িয়ে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে।
ট্রাম্প বারবার বলেছেন, বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র উপকৃত হচ্ছে এবং চীন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। যদিও বাস্তবে তেমনটা দেখা যায়নি। ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের পর চীনা রফতানি আরো সম্প্রসারণ দেখেছে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দুই বছর সংকুচিত হলেও ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতি বছর চীনের মোট রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
চীন সে সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরে দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য সম্প্রসারণে মনোযোগ দিয়েছিল। এ পদক্ষেপের আওতায় ২০১৯ সালে চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা দখল করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০ দেশের একটি জোট। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় এ অঞ্চলে চীনের বাণিজ্য সম্প্রসারণ আগামীতে আরো বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, শুল্কগুলো মার্কিন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। যখন চীনের অর্থনীতি ২০১৯ সালে ৫০ বছরের মধ্যে খারাপ বছরে পরিণত হয়েছিল। তবে অর্থনীতির আকারের তুলনায় প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাব খুব সামান্যই ছিল। আর এ প্রভাবে দুই অর্থনীতিকেই ভুগতে হয়েছে। এছাড়া চীনের প্রযুক্তি জায়ান্টসহ বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি খাতে চীনকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে সহযোগিতা করছে।
চীনের ওপর শুল্ক আরোপে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হচ্ছে—বরাবর এ দাবি করে আসছিলেন ট্রাম্প। অর্থনীতিবিদরা খতিয়ে দেখে অবাক হন যে বর্ধিত শুল্কে পণ্যের দাম কমাননি চীনা রফতানিকারকরা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে বর্ধিত শুল্কের বোঝা চেপেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই। কারণ বেশির ভাগ শুল্ক দিতে হয়েছে মার্কিন কোম্পানি ও ভোক্তাদের। ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুল্কের কারণে ২০১৮ সালে ১ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার খুইয়েছে মার্কিন ভোক্তারা।
মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ইয়াং ঝোয়ের মতে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে শুল্কের কারণে জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ ক্ষতি হলেও চীন ৬ শতাংশ বা তারও বেশি প্রবৃদ্ধির ধারা বহাল রাখে। দুই পরাশক্তির এ লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছে ভিয়েতনাম। এ শুল্কের কারণে চীন থেকে মার্কিন সংস্থাগুলো ভিয়েতনামে স্থানান্তরিত হওয়ায় দেশটির জিডিপিতে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ যুক্ত হয়েছিল। সূত্র ব্লুমবার্গ