সম্প্রতি শব্দ ও বায়ু দূষণের উৎস, পরিমাণ এবং ক্ষতিকারক দিকগুলো নির্ণয় করার জন্য স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক প্রফেসরড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার এর নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের একটি গবেষক দল তাদের সমগ্র দেশব্যাপী পরিচালিত জরিপের অংশ হিসাবে দুই দিনব্যাপী বন্দর নগরী চট্রগ্রাম জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বয়ংক্রিয় বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে শব্দ ও বায়ুর মান পরিমাপ করে এ তথ্য জানিয়েছে।
হাসপাতাল ও ক্লিনিক, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, গির্জা, দশটি আবাসিক এলাকা, দশটি বাণিজ্যিক এলাকা, দশটি মিশ্র এলাকা, দশটি বিভিন্ন ধরনের কারখানা ও শিল্প এলাকা এবং দশটি ব্যস্ততম রাস্তার সংযুক্তি পূর্ণ এলাকা ও মোড় এবং তুলনামূলক পর্যালোচনা জন্য দশটি গ্রামীণ পরিবেশের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করে গবেষক দলটি।
গবেষণায় পাওয়া প্রাথমিক তথ্য থেকে চট্রগ্রাম জেলা শহরের শব্দ ও বায়ুদূষণের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেশি পেয়েছেন তারা।
প্রাথমিকভাবে শব্দ দূষণের উৎস হিসাবে গবেষক দল যানবাহন চলাচলের শব্দ (হর্ণ, ইঞ্জিন ও চাকার কম্পন), বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের শব্দ, রাস্তার নির্মাণ, খোঁড়াখুঁড়ি ও মেরামতের কাজ, ভবন ও অন্যান্য নির্মাণ কাজের মধ্যে ইট ও পাথর ভাঙ্গা মেশিন ও টাইলস কাটার মেশিন হতে শব্দ, ভবন ভাঙ্গার শব্দ, কলকারখানার শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের মাইকিং ইত্যাদিকে চিহ্নিত করেছে।তবে যানবাহনের হর্ণ সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ করছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণায় আরও উঠে আসে, অনেক ক্ষেত্রে দূর দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকরা বিনোদনের জন্য উচ্চমাত্রার সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে চট্রগ্রামের শব্দ দূষণের একটি মূল কারণ।নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে যেখানে শব্দের গ্রহণযোগ্য মান মাত্রা ৫০ থেকে ৬০ ডেসিবেলের মধ্যে থাকার কথা ছিল সেখানে এই গবেষণায় অধিকাংশ স্থানে তার প্রায় দেড় থেকে দুই গুন বেশি শব্দের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কিন্তু অধিকাংশ আবাসিক এলাকা ও গ্রামীণ পরিবেশে শব্দের পরিমাণ মান মাত্রার মধ্যেই ছিল। রাস্তার উপরে বা রাস্তার পাশের স্থানগুলোতে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ লক্ষ করেছে গবেষক দলটি।
গবেষণাটির নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন এর যুগ্ন সম্পাদক প্রফেসর ড. আহমদকামরুজ্জমান মজুমদার জানান, জরিপ পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে হর্ন গণনার ফলাফল অনুযায়ী বিপনী বিতানগুলোর সামনের রাস্তায় হর্ন ব্যবহারের দিক থেকে সবার শীর্ষে। নগরীর ব্যস্ত সড়কগুলোতে সাধারণ হর্ন এর সাথে সাথে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের আধিক্য লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল কর্তৃক অতিমাত্রায় হর্ন দেওয়া গবেষকদলের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।এমন অতিমাত্রার শব্দদূষণের কারণে রাস্তায় চলাচল কারী পথচারী, পর্যটক, ট্রাফিক পুলিশ,হকার,শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের কানের পর্দা ফেটে যাওয়া সহসাময়িক ভাবে বধিরতা থেকে স্থায়ী বধিরতার আশঙ্কা রয়েছে।
অপরদিকে বায়ু দূষণের উৎস গুলির মধ্যে যানবাহনের কালো ধোঁয়া, অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি কে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে গবেষক দলটি।বর্তমানে শহরের প্রায় অর্ধেক রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, সংস্কার বা বর্ধিতকরণ এর আওতায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কারণে বায়ু দূষণ একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।এছাড়া নগরীর হোটেল, মোটেল,রিসোর্ট সী বিচ সহ যেখানে সেখানে গতানুগতিক পদ্ধতিতে বারবিকিউ করার জন্য উম্মুক্ত ভাবে কাঠ ও কয়লা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে প্রচুর পরিমাণে বায়ু দূষিত হয়।
বায়ু দূষণের কারণে এক চরম ভোগান্তির ভিতরে রয়েছে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা সহ হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু পর্যটকও। প্রধান সড়কগুলোর পাশে স্থান বিশেষে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত মান মাত্রা থেকে প্রায় ২ থেকে ৮গুণ বেশি বায়ুদূষণ লক্ষ করেছে গবেষক দলটি। প্রধান সড়কগুলো থেকে ভিতরের দিকে বায়ু দূষণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম লক্ষ করেছে তারা।
প্রফেসর ড. আহমদকামরুজ্জমান মজুমদার শব্দ দূষণ রোধকল্পে চট্রগ্রামকে কে হর্ন মুক্ত নগরী হিসেবে ঘোষণা করার পরামর্শ দেন। সেই সাথে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী চিহ্নিত জোনসমূহে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট উপস্থাপন করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
বায়ু দূষণ রোধ করার জন্য রাস্তার নির্মাণকাজ ও সংস্কার কাজ স্বল্পতম সময়ে সম্পূর্ণ করার সাথে সাথে নির্মাণকালীন সময়ে নির্মাণ স্থান এবং নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া নগরীর সড়কগুলোতে সকাল বিকাল নিয়মিতভাবে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করার কথা বলেন।