ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্যের কাঁচামাল কেনার নামে ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়েছে আনোয়ার ইষ্পাত। এসপিএস ট্রেডিং নামের ওই ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে টাকা পরিশোধের দিন বা একদিন পরেই আনোয়ার গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠানে সমপরিমাণ টাকা ফেরত দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত চার বছরে এসপিএস ট্রেডিংকে সেতু হিসেবে ব্যবহার করে এক হাজার ৭৮ কোটি টাকা সরিয়েছে গ্রুপটি। লেনদেনের বিপরীতে এক টাকাও ভ্যাট পরিশোধ করেনি তারা। অন্যদিকে সরেজমিন ঘুরে এসপিএস ট্রেডিং নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্ত অনুযায়ী, স্ক্র্যাপ আয়রন কেনার নামে এসপিএস ট্রেডিংয়ের হিসাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা জমা করে আনোয়ার ইষ্পাত। ওইদিন বা একদিন পরেই টাকাটা আনোয়ার গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠান আনোয়ার সিমেন্টের ব্যাংক হিসাবে জমা করে এসপিএস ট্রেডিং। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ২০টি লেনদেনের মাধ্যমে ৪৯ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার অবৈধ লেনদেন শনাক্ত করা হয়েছে। পুরো টাকাটাই আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ব্যাংকিং লেনদেনের বিপরীতে এক টাকাও ভ্যাট পরিশোধ করেনি আনোয়ার ইষ্পাত।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টাকাগুলো বিদেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অস্তিত্বহীন একটি প্রতিষ্ঠানকে পণ্যের মূল্য পরিশোধের কোনো প্রশ্নই আসেনা। ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের জন্য এসপিএস ট্রেডিং নামের একাটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া এক হাজার কোটি টাকা লেনদেনের বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে তারা। যার অংক ১৬১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
চতুর্থ প্রজন্মের একটি ব্যাংক থেকে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর দুই কোটি ৪৬ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকার একটি মেয়াদী ঋণ নেয় আনোয়ার ইস্পাত। এই অর্থ দিয়ে এসপিএস ট্রেডিংয়ের স্ক্র্যাপ আয়রনের মূল্য পরিশোধ করা হয়। টাকাগুলো জমা করা হয় সিটি ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায়। কিন্তু ওই দিনই (৯ ডিসেম্বর) সিটি ব্যাংক থেকে আনোয়ার গ্রুপের অপর কোম্পানি আনোয়ার সিমেন্টের একাউন্টে টাকাগুলো (দুই কোটি ৪৬ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকা) ফেরত দিয়েছে এসপিএস ট্রেডিং। যে চেকের মাধ্যমে এই টাকাটা ফেরত বা স্থানান্ত করা হয়েছে তার নম্বর ছিল- ৩৫৭৮০১৭। ওই দিন অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর আরও একটি ঋণ তৈর করা হয় এবং একই প্রক্রিয়ায় আনোয়ার সিমেন্টের ব্যাংক একাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করে এসপিএস। পরেরবার ঋণের অংক ছিল দুই কোটি ৫৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪০০ টাকা। অর্থগুলো স্থানান্তরে যে চেক ইস্যু করা হয়েছিল তার নম্বর ছিল- ৩৫৭৮০১৬। এছাড়াও ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুই কোটি ৫১ লাখ ৫২ হাজার, ২৪ মার্চ দুই কোটি ৪৯ লাখ ২৮ হাজার , ১৪ জুন দুই কোটি ৪৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একই পদ্ধতিতে ওই কোম্পানিকে ফেরত দেয়া হয়েছে।
স্ক্র্যাপ আইরন কেনার নামে একাধিক ব্যাংকের একাধিক একাউন্ট ব্যবহার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যেসব শাখা থেকে এসপিএস ট্রেডিংয়ের একাউন্টে আনোয়ার ইষ্পাত টাকা জমা করেছে এর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংকের দিলকুশা শাখা, ট্রাস্ট ব্যাংকের সেনা কল্যাণ শাখা, এনসিসি ব্যাংকের দিলকুশা ও মতিঝিল শাখা, আইএফআইসি ব্যাংকের ফেডারেশন শাখা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা মেইন শাখা, ঢাকা ব্যাংক স্থানীয় অফিস এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা, সিটি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল ও বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা অন্যতম।
সিটি ব্যাংকে হিসাব খোলার সময় দেওয়া ঠিকানাতে গিয়ে এসপিএস ট্রেডিং এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা বলছেন এই নামে কোন প্রতিষ্ঠান কোনদিনই এখানে ছিল না। চট্টগ্রামের ৩ নং জেটি গেট সংলগ্ন হাকিম মিনি সুপার মার্কেটের পঞ্চম তলায় এখন ট্রিম ট্রেড লিমিটেড, মেসার্স শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজ, জেইন কর্পোরেশন, রেহানা ট্রেডিং ও রবি ইন্টারন্যাশনালের অফিস।
এবিষয়ে জানতে মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সরাসরি অফিসে গিয়েও আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ার হোসেনের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রথমদিন যোগাযোগ করলে সন্ধ্যায় আবার যোগাযোগ করতে বলেন এমডির ব্যক্তিগত সহকারি। সন্ধ্যাবেলাতেও কোনো সাড়া দেননি এমডি। পরেরদিন যোগাযোগা করা হলে মিটিংয়ে ব্যস্ততার কথা জানান সহকারি। সরাসরি আনোয়ার ইস্পাতের কার্যালয়ে গেলে ব্যক্তিগত সহকারি জানান এখন স্যার মিটিংয়ে আছেন। দেখা করা সম্ভব নয়। হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্নে লিখে পাঠানোর পরামর্শ দেন ওই সহকারি। কিন্তু প্রতিবেদন লেখার আগ পর্যন্ত কোনো উত্তর আসেনি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।