চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে নিজেদের মাঠ এস্তাদিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে লিভারপুলকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। জোড়া গোল করেছেন ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। বাকি একটা গোল স্প্যানিশ উইঙ্গার মার্কো আসেনসিওর। লিভারপুলের হয়ে সান্ত্বনাসূচক গোলটা করেছেন মিসরীয় উইঙ্গার মোহাম্মদ সালাহ। বলা যেতেই পারে, এই জয়ের মাধ্যমে সেমিতে এক পা দিয়েই রাখল রিয়াল মাদ্রিদ।
রামোস-ভারানহীন রিয়াল রক্ষণভাগ সাজিয়েছিল লুকাস ভাসকেজ, এদের মিলিতাও, নাচো ফের্নান্দেস ও ফারলঁদ মেন্দিকে দিয়ে। ৪-৩-৩ ছকে মিডফিল্ডে যথারীতি ছিলেন কাসেমিরো, টনি ক্রুস আর লুকা মদরিচ। ওদিকে আক্রমণভাগে স্ট্রাইকার করিম বেনজেমার দুপাশে মার্কো আসেনসিও ও ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। ওদিকে একই ছকে নেমেছিল লিভারপুলও। গোলরক্ষক আলিসনের সামনে ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড, ওজান কাবাক, ন্যাট ফিলিপস ও অ্যান্ডি রবার্টসন। মিডফিল্ডে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার থিয়াগো আলকানতারাকে না নামিয়ে নাবি কেইতাকে নামিয়ে একটা ফাটকা খেলতে চেয়েছিলেন কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। কেইতার সঙ্গে মিডফিল্ডে ছিলেন ব্রাজিলিয়ান ফাবিনিও ও জর্জিনিও ভাইনালডম। নিয়মিত আক্রমণভাগের রবার্তো ফিরমিনোকে বসিয়ে নামানো হয়েছিল ফর্মে থাকা দিওগো জোতাকে। সঙ্গে সাদিও মানে আর মোহাম্মদ সালাহ।
প্রথম থেকেই লিভারপুলের ওপর চেপে বসে রিয়াল। ম্যাচ শুরুর আগে রাফায়েল ভারানের কোভিড পজিটিভ হওয়ার খবর শোনা গিয়েছিল, সে খবরে রিয়াল বিচলিত হবে— এমনটা মনে করা হলেও গোটা ম্যাচ জুড়েই রিয়াল বুঝিয়েছে, চ্যাম্পিয়নস লিগ আসলেই তারা কেন অন্যগ্রহের একটা দল হয়ে যায়। রিয়াল খুব ভালোভাবেই জানত, লিভারপুলের ওপরে উঠে আসা রক্ষণভাগকে নিয়মিত আক্রমণ করার মাধ্যমে ফাটল ধরাতে হবে। গতির মাধ্যমে পরাস্ত করতে হবে, তবেই চাপে ভেঙে পড়বে অল রেডরা। সেটাই হয়েছে।
সঙ্গে ক্রুস-মদরিচের দুর্দান্ত মিডফিল্ড তো ছিলই। বিশেষ করে টনি ক্রুস। চলতি মৌসুমে এই জার্মান মিডফিল্ডার যে অসাধারণ ফর্মে আছেন, তাঁর আরেকটা প্রমাণ দেখা গেল কালকে। ম্যাচ জেতার জন্য ক্রুসকে আটকে রাখার বিকল্প ছিল না লিভারপুলের। কিন্তু সে কাজটা ঠিকঠাক করতে পারল কোথায় তারা? ম্যাচের ২৭ মিনিটেই লিভারপুলের ডানদিকের দুই সেন্টারব্যাকের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা উদ্দেশ্য করে দৌড়ে যাওয়া ভিনিসিয়ুসের দিকে লক্ষ্য করে নিজেদের রক্ষণভাগ থেকে নিখুঁত বল বাড়ান এই ক্রুস। গোল করতে সমস্যা হয়নি এই গতিশীল উইঙ্গারের। গোটা মৌসুম জুড়ে 'ফিনিশ' করতে পারেন না, এমন অপবাদ শোনা ভিনিসিয়ুস যেন এই ম্যাচে অপবাদ ঘোচাতেই নেমেছিলেন।
আট মিনিট পর স্প্যানিশ উইঙ্গার মার্কো আসেনসিওর গোলে ব্যবধান বাড়িয়ে নেয় রিয়াল। এই গোলেও দায় আছে লিভারপুলের ভঙ্গুর রক্ষণের। ক্রুসের বাড়ানো পাস হেড করে বিপদ্মুক্ত করতে গিয়ে উল্টো দলের বিপদ আরও ডেকে আনেন লিভারপুলের রাইটব্যাক ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড। এই নিয়ে টানা চার ম্যাচে গোল করলেন আসেনসিও। ক্যারিয়ারে এর আগে আর কখনো এই কীর্তি করা হয়নি তাঁর।
নাবি কেইতাকে নামানোর সিদ্ধান্তটা যে কতটা ভুল ছিল, সেটা বোঝার জন্য এর চেয়ে বেশি সময় নেননি ইয়ুর্গেন ক্লপ। চল্লিশ মিনিটের মাথায় এই গিনিয়ান মিডফিল্ডারকে নামিয়ে থিয়াগো আলকানতারাকে মাঠে নামান এই জার্মান কোচ। এরপর দ্বিতীয়ার্ধে মোহাম্মদ সালাহ গোল করে দলের আশা একটু জাগিয়েও তোলেন। কিন্তু ওই যে, ভিনিসিয়ুস যে নিজেকে প্রমাণ করতে নেমেছিলেন এ দিন!
কর্নারের কাছ থেকে পাওয়া এক থ্রো-ইন থেকে বল পেয়ে যান লুকা মদরিচ, সেখান থেকে বল বাড়ান বক্সে ওঁত পেতে থাকা এই তরুণ ব্রাজিলিয়ানের দিকে। স্কোরলাইন নিমেষেই হয়ে যায় ৩-১। পরে আর গোল শোধ করা হয়নি লিভারপুলের। গত দুই ম্যাচ ধরে ফাবিনিও আর থিয়াগোর মিডফিল্ড জুটি যেখানে লিভারপুলকে স্বপ্ন দেখাল, সেখানে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে থিয়াগোর জায়গায় কেইতার খেলান বেশ প্রশ্নবিদ্ধ ঠেকেছে। থিয়াগো নামার পরে মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ লিভারপুলের দিকে একটু ঝুঁকলেও ততক্ষণে যা ঝামেলা হওয়ার হয়েই গিয়েছিল। আর লিভারপুলের এই দ্বিধার সুবিধাই পুরোদমে নিয়েছেন ক্রুস আর মদরিচ। এই চ্যাম্পিয়নস লিগ মৌসুমে প্রতি ম্যাচে প্রায় দশটা করে লং বল খেলছেন ক্রুস, যার নব্বই শতাংশই সফল। পুরোনো চালে ভাতে বাড়ার মতোই উদাহরণ এ দুজন।
লিভারপুলের আশা এখনও টিমটিম করে জ্বলছে মোহাম্মদ সালাহর করা ওই এক অ্যাওয়ে গোলের কল্যাণেই। তবে নিজেদের মাঠে দ্বিতীয় লেগে যদি তারা ফর্মে ফিরে না আসে, এই এক গোল দিয়েও কোনো লাভ হবে না। কারণ, চ্যাম্পিয়নস লিগের রিয়ালকে হারাতে দরকার হয় বিশেষ কিছুর।