তবে বাংলাদেশের পূঁজিবাজার এমনিতেই আইসিইউতে রয়েছে। তার উপর এখনও করোনাভাইরাসের গুজবের কারণে দিনের পর দিন তলানিতে নামছে পূঁজিবাজার। আজও ভয়ংকর ধস নেমেছে পূঁজিবাজারে। লেনদেনের প্রথম ২০ মিনিটেই মধ্যে ডিএসইএক্স বা প্রধান মূল্য সূচক ১৮১ পয়েন্ট বা ৪.৪০ শতাংশ কমেছে।
এক শ্রেনীর কুচক্রিমহল গুজব ছড়িয়ে বাজারের পতন ঘটিয়ে কম দামে শেয়ার হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। এই অবস্থায় গুজবে কান না দিয়ে স্থিতিশীলভাবে শেয়ার কেনা-বেচা করার পরামর্শ দিয়েছেন পূঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা।
করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, জ্বালানি তেলের দামে বড় পতন আর বিশ্ব-অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান মন্দার আশংকার প্রভাবে গত সপ্তাহের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে পুঁজিবাজারে ছিল প্রচণ্ড অস্থিরতা।
তবে শুক্রবার ডাউ জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনডেক্স-৩০তে সূচকের ব্যাপক উত্থানের মধ্যে লেনদেন শেষ হয়। ডাউ জোনসে একদিনে ১৯৮৫ পয়েন্ট বেড়ে ২৩১৮৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আগে সূচক ছিল ২১২৮৫। এছাড়া নাসডাক-১০০ নন-ফিনান্সিয়াল ইনডেক্স বেড়েছে ৭৩১ পয়েন্ট এবং এসএন্ডপি৫০০ ইনডেক্স বেড়েছে ২৩০ পয়েন্ট। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধানসূচক এসঅ্যান্ডপি ৫০০ আগের দিনের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ উপরে উঠে লেনদেন শেষ করে। ২০০৮ সালের পর এই বাজারে একদিনে সূচক আর এতটা বাড়েনি।
শুক্রবার ভারতের বাজার ভয়াবহ পতনকে সঙ্গী করে লেনদেন শুরু হলেও মাত্র ৩৫ মিনিটের মধ্যে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ ও ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকগুলো ১০ শতাংশের বেশি কমে গিয়ে সার্কিটব্রেকার অতিক্রম করে ফেলে। এতে দেশটির বাজারে ৪৫ মিনিট লেনদেন বন্ধ থাকে। এরপর লেনদেন শুরু হলে বাজার ধীরে ধীরে উর্ধমুখী হয়ে উঠে। দিনশেষে সূচক শুধু পুনরুদ্ধারই হয়নি, তা আগের দিনের অবস্থানকে ছাড়িয়ে যায়। ঐদিন বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে সেনসেক্স সূচক ৩৪ হাজার ১০৩ পয়েন্টে স্থির হয়, যা আগের দিনের চেয়ে ১ হাজার ৩২৫ পয়েন্ট বা প্রায় ৪ শতাংশ বেশি। ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক নিফটি ৫০ একইভাবে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
শুক্রবার এদিন ফ্রান্সের সিএসই ৪০ সূচক ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, জার্মানির ডিএএক্স সূচক ৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যের এফটিএসই ১০০ সূচক ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
করোনাভাইরাসে ইউরোপের সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশ ইতালীতেও শুক্রবার সূচকের নাটকীয় উত্থান ঘটে। এদিন দেশটির প্রধান সূচক আগের দিনের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আগের দিন বাজারটিতে সূচক ১৭ শতাংশ কমেছিল। এর প্রেক্ষিতে দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারে শর্টসেল (নিজের কাছে শেয়ার না থাকলেও তা আগাম বিক্রির ব্যবস্থা) নিষিদ্ধ করে। আর তাতেই বেশকিছুটা সুফল আসে। এদিন অস্ট্রেলিয়ার বাজারেও উর্ধমুখী ধারা দেখা যায়। অবশ্য দেশটির বাজার এদিন ছিল ভারতের মত নাটকীয়তায় ভরা। দিনের প্রথমভাগে এখানে প্রধান মূল্যসূচক এসঅ্যান্ডপি/এএসএক্স ২০০ আগের দিনের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশ কমে গেলেও দিনশেষে বাজারে ছিল হাসিমুখ। কারণ হারানো সূচক পুনরুদ্ধারের পর আরও ৪ দশমিক ৪ শতাংশ উপরে উঠে স্থির হয় ওই সূচক।
জাপানের প্রধান সূচক নিক্কি ২২৫ ইনডেক্সে ৩০ বছরের মধ্যে তীব্রতম পতন হয়। কিন্তু পরে বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। দিনশেষে সূচক আগের দিনের চেয়ে ৬ শতাংশ নিচে এসে স্থির হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারের প্রধান সূচক কেওএসপিআই শুক্রবার এক পর্যায়ে ৭ শতাংশের বেশি কমে গেলেও পরে এর অনেকটাই পুনরুদ্ধার হয় এবং আগের দিনের চেয়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ নিচে থেকে লেনদেন শেষ করে। এদিন হংকং এর হ্যাংসেং ইনডেক্স ১ দশমিক ১ শতাংশ এবং চিনের সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পায়।
বিশ্লেষকদের মতে, করোনাভাইরাস আতঙ্কের প্রথম ধাক্কা কেটে যাওয়ায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রণোদনা ঘোষণা ইত্যাদি বিষয় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে বাংলাদেশের পূঁজিবাজার। এখানকার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখনও করোনাভাইরাসের আতঙ্ক কাটেনি। দিনের পর দিন তলানীতেই নামছে পূঁজিবাজার। গত সপ্তাহের সার্বিক লেনদেন শেষ হয়েছে পতনে। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস বড় পতন, করোনা ভাইরাস আতংকে দ্বিতীয় কার্যদিবস ব্যাপক পতন। পরের দুই কার্যদিবস বড় উত্থান এবং শেষ কার্যদিবসে আবার বড় পতন। সাপ্তাহিক বাজার চিত্রে দেখা যায়, সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তিন কার্যদিবস সূচক কমেছে আর দুই কার্যদিবস সূচক বেড়েছে। অর্থাৎ বাড়া কমার হিসাব শেষে দেখা গেছে গত সপ্তাহে উভয় শেয়ারবাজারের সব সূচক কমেছে। এভাবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়েই চলেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ কারণে দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়েছেন। এর ফলে শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেশে কি পরিমান ক্ষতি হবে বা অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে তা তারা জানে না। না জেনেই একটি কুচক্রি মহলের প্রচারণায় কান দিয়ে শেয়ার বিক্রির হিড়িক ফেলেছে। এতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
জানা যায়, একটি কুচক্রিমহল গুজব ছড়িয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছে এবং দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা শেয়ার বিক্রি করে চলে যাবে। তখন বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে পতন হবে। আর এই গুজবে কান নিয়ে কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রির জন্য উঠে পড়ে লেগেছে এবং বাজারে পতন হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা অর্থসংবাদকে জানান, ‘করোনাভাইরাসের কারণে দেশের শেয়ারবাজারে যে অবস্থা চলছে তা খুবই ন্যাক্কারজনক। আমাদের বাজার সম্পর্কে ভালো ধারনা নেই অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর। তাই বিভিন্ন মহলের কথা শুনে শেয়ার কিনছে এবং বিক্রি করছে। এতে বাজারের যে স্বাভাবিক গতি থাকার কথা তা থাকছে না। বাজার খুব অস্বাভাবিক গতিতে উঠা-নামা করছে। তবে বিনিয়োগকারীদের উচিত গুজবে কান না দিয়ে প্রকৃত অবস্থা জেনে শেয়ার কেনা ও বিক্রি করা। আর অরেকটি বিষয় বিনিয়োগকারীদের মাথায় থাকা দরকার তা হলো, বাজারে পতন হওয়ার সময় কেন শেয়ার বিক্রির জন্য উঠে পড়ে লাগতে হবে? বাজারে যখন পতন চলছে, তখন বরং কেনা উচিত। তাই বিনিয়োগকারীদের প্রতি অনুরোধ, গুজবে কান না দিয়ে বাজারের বর্তমান অবস্থা বিচার করে শেয়ার কিনবেন এবং বিক্রি করবেন ’
’