শনিবার (২৯ মে) “গ্রামীণ নারী ও আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যরোধ এবং কৃষির সংস্কারে বাজেট বৃদ্ধির গুরুত্ব’’ শীর্ষক এক জাতীয় ওয়েবিনারে এ কথা বলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
এএলআরডি, এইচডিআরসি ও দৈনিক বণিক বার্তার যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। অনুষ্ঠানে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ও গবেষক ড. আবুল বারকাত। এর আগে অনুষ্ঠানে আয়োজকদের পক্ষে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ ও ওয়েবিনারের উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন এএলআরডি’র উপ-নির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি।
ওয়েবিনারের বিশেষ সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে রাশেদ খান মেনন বলেন, ২০১৪ সালের পর থেকে দেশের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগতভাবে অতি ক্ষুদ্র ধনিক গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে। করোনার জন্য যে প্রণোদনার ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন সেটির সুফল ঐ গোষ্ঠীই ভোগ করেছে, সাধারণ মানুষের কাছে তা সেভাবে পৌঁছুয়নি। তিনি আরো বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিংবা মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তনে কোনো কাজে আসেনি বরং আয় বৈষম্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পারিবারিক কৃষিতে নারীর স্বীকৃতি নেই, সাধারণ কৃষকরা এখনো রাষ্ট্রীয় সেবা ও সুরক্ষা বেষ্টনি থেকে বঞ্চিত। আদিবাসীরা উপেক্ষিত সেই কারণে বাজেট আলোচনায় তাদের জন্য এখন আর কোন আলাদা সময় বরাদ্দ কিংবা কোনো আলোচনাই হয় না। সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশনের বিষয়ে সংসদে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও কোন উদ্যোগ আর নেই।
মূল প্রবন্ধে ড. আবুল বারকাত উল্লেখ করেন, গত একবছরে করোনা পূর্ব দারিদ্র্যের হার দেড় থেকে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ ব্যাপকহারে শ্রেণি মইয়ের নিচের দিকে নামতে বাধ্য হয়েছেন। প্রান্তিকতা-বঞ্চনা-বৈষম্যের নানান মাত্রার তীব্রতা বেড়েছে। প্রথম লকডাউনের ২ মাসে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ৩ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ। এ ধারা চলতে থাকলে এবং লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলে কিছু থাকবে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। প্রথম নয় মাসে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক এডিপির মাত্র ২১ শতাংশ ব্যয়ের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার পক্ষ থেকে করোনা মোকাবেলায় যেসব বরাদ্দের কথা বলা হয় বাস্তবে এসব বরাদ্দের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে কমই পৌঁছেছে। ‘এক ইঞ্চি আবাদি জমিও ফেলে রাখা যাবেনা’ প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পরও কৃষি উপকরণ সরবরাহের ঘাটতি ও উচ্চমূল্যের কারণে অনেক প্রান্তিক কৃষক স্বাভাবিক চাষাবাদে সক্ষম হননি। পারিবারিক কৃষিতে নিয়োজিত প্রান্তিক কৃষকদের অধিকাংশই বাজেট বক্তৃতায় প্রতিশ্রুত সহায়তার বাইরে রয়ে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, করোনার আগে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২১.৮% থাকলেও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তা ছিল ৬০%। করোনাকালে কর্মহীনতা, মজুরীস্বল্পতা, উৎপাদিত পণ্যের মূল্য না পাওয়া, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা- এসব আদিবাসী মানুষের দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে তীব্রতর করেছে, দারিদ্রের হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাজেটে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য যৌক্তিক বাজেট বরাদ্দ হ্ওয়া উচিৎ ১২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা উল্লেখ করে প্রবন্ধে তিনি ১১টি সুনির্দিষ্ট খাতে মোট ৩৬টি সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পারিবারিক কৃষিকে স্বীকৃতি প্রদানে এবং স্বীকৃতির বাস্তবায়নে যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ রাখা; কৃষকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের বীমা, আবাসন, শস্য, গবাদিপশু শিক্ষা স্বাস্থ্য চালুর জন্য ব্যবস্থা রাখা; বাজেটে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের জন্য ভ্যাট এবং ট্যাক্স ম্ওকুফ করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ড. সানজিদা আক্তার প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, কৃষিতে নারী অংশগ্রহণ ক্রমান্বয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কৃষি ব্যবস্থা নারী বান্ধব হচ্ছে না। তারই ফলে বাজেটেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এখনও নারীর কৃষি কাজ ও শ্রমকে সেই পুরুষতান্ত্রিক অবস্থান থেকে বিবেচনা করা হয় বলে এর কোন পরিবর্তন দেখা নেই। এই কাঠামোগত বাধা থাকার কারণে নারীদের কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি নাই। তাই তিনি এই অবস্থার পরিবর্তন প্রত্যাশা করে এবারের বাজেটে নারীর কাজের ধরণ অনুযায়ি পৃথক পৃথক বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে বলে দাবি জানান।
বাজেট বরাদ্দ গুরুত্বপূর্ণ তবে কোন জায়গায় বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে সেই কর্মসূচি সুনির্দিষ্ট হওয়া এবং তার জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বিআইডিএস-এর রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, নারীদের জন্য সুনির্দিস্ট কার্যক্রমের ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল। তাদের বাজার ব্যবস্থার অভিগম্যতার জন্য অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি। সেই সাথে নারীদের বাজার ব্যবস্থায় যুক্ত করতে পারলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া আদিবাসীদের বিশেষ করে সমতলের শিশুদের শিক্ষা ব্যাবস্থার উন্নয়নের জন্য বাজেটে আলাদা করে বরাদ্দ থাকা দরকার।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং দরিদ্রদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার একটি সুনির্দিষ্ট অংশ আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ রাখার দাবি জানান। তিনি চরম দারিদ্র্য থেকে আদিবাসী পরিবারসমূহকে সুরক্ষার জন্য ২০ হাজার আদিবাসী নারী-পুরুষকে অন্তত ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং এ জন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দের সুপারিশ করেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি এএলআরডি নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, প্রচলিত বাজেট প্রণয়ন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। কেন্দ্রীয়ভাবে মন্ত্রণালয় ও আমলানির্ভর বাজেটে তৃণমূলের মানুষ বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের কোনো অংশগ্রহণ নেই এবং একটা ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাজেট প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ প্রক্রিয়া থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। তিনি বাজেট প্রণয়নের অন্তত ছয় মাস আগে থেকে তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের সাথে আলোচনার সুপারিশ করেন। এর জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের উদ্যোগী ভূমিকার আহ্বান জানান তিনি।
মুক্ত আলোচনা পর্বে যুক্ত হয়ে অংশগ্রহণকারীরা চলনবিলের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ রাখার দাবি জানান। সেই সাথে নারীদের কৃষি কাজ ও শ্রমের জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকা অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া অংশগ্রহণকারীগণ এ সময় চ্যাট বক্সে তাদের মতামত লিখেও জানান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো-
-আদিবাসীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ প্রণয়নে সঠিক জনসংখ্যার পরিসংখ্যান প্রয়োজন। আদিবাসীদের জন্য পৃথক শুমারি করতে হবে।
-সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি রক্ষায় স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনের উদ্যোগ ও বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন।
-সমতলের আদিবাসীদের বাজেট বরাদ্দ গুলো বন্টনে অব্যবস্থাপনা। আদিবাসীদের বাজেট অন্যরা ভোগ করছে। মনিটরিং সেল গঠন করা দরকার।
-বাজেটে আদিবাসীদের জন্য পৃথক অনুচ্ছেদ করে বাজেটের বরাদ্দের খাতগুলো উল্লেখ করতে হবে।
-জনবান্ধব বাজেটের জন্য সব স্তরের জনগনের(নারী, পুরুষ, আদিবাসী, শিশু) চিন্তা চেতনা যাতে জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হয় ও বাজেটে বরাদ্দ থাকে তার জন্য বাজেট তৈরীর আগে সকল স্তরের জনগনের মতপ্রয়োগের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন।
-জাতীয় বাজেটে প্রান্তিক কৃষক সমবায় তৈরিতে প্রণোদনা বা বাজেট বরাদ্দ রাখা উচিত এবং সেই সব প্রান্তিক কৃষক সমবায়কে কৃষ আধৃনিকায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি সহজ শর্তে দেয়ার উদ্যোগ নিতে প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ সময়ের দাবি।
-চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। ভূমি অধিকার, মজুরি বৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি।
-কৃষিপণ্য পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থার ত্রুটি সংশোধন করার জন্য মাল-পরিবাহী ট্রেন চালনা করা জরুরি এবং এটিকে জরুরি সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এছাড়া আমাদের অনেক ট্রেনের বগি অকেজো পড়ে রয়েছে। এগুলোকে প্রতিটি যাত্রিবাহী ট্রেনের সাথে সংযুক্ত করে কৃষিপণ্য সরবরাহের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে।
-উপজেলা পর্যায়ে মাটি পরীক্ষা ল্যাব ও কীটতত্ত্ব ল্যাব স্থাপন করলেই দায়িত্ব পালন শেষ হবে না, এসব ল্যাবে মাটি ও কীটতত্ত্ব পরীক্ষার জন্য এবং বিষাক্ত সার ও বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকদের সচেতন ও উৎসাহিত করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া জরুরি।