এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।”
এই জগৎ সুন্দর এবং মধুময়। আমাদের হাসি-কান্না, মান-অভিমান, আবেগ-ভালোবাসায় পৃথিবী পরিপূর্ণ। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অন্য কিছুর আহ্বানে প্রলুব্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে চাননি ভারতের রবি বিশ্বকবি। সেতো শত বছর আগের কথা। তাঁর বেঁচে থাকার সখ ছিল শুধু কি নিতে? না, তিনি দিয়ে গেছেন পৃথিবীর মানুষকে ভালোবাসার বাণী, যে বাণীতে রয়েছে পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার কথা। একা একা তিনিও নির্জন নিরবে বাস করতে চাননি, তিনিও চেয়েছেন মানুষের মাঝে বাস করতে। আমরা না চাইতে শত শত বছর ধরে সে সুযোগটি পেয়েছি। কিন্তু মানুষের মাঝে ঘুরেছি, তাদের করুণ আর্তনাদ দেখেছি, রাস্তার পাশে ড্রেনে পড়ে না খেয়ে কুষ্ঠিরোগে পড়ে থাকতে দেখেছি। মানুষের মাঝে কখনও বাস করিনি। শুধু নিজেকে নিয়ে মনের আনন্দে ঘুরেছি, ফিরেছি, খেয়েছি। কখনও মানুষের কথা ভাবিনি। আজ পড়ন্ত বিকেলে হঠাৎ মনে পড়ছে কেন এতদিন লেগে গেল বুঝতে যে আমিও মানুষের মাঝে বাঁচিবারে চাই, অর্থ বা প্রাচুর্যের মাঝে নয়।
সারা জীবন শিক্ষা পেয়েছি, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে, সুখে-দুখে এক সঙ্গে বসবাস করতে হবে। অথচ সে কাজগুলো করা পড়ে থাক, সুযোগ পেলেই তাদের পেটে লাথি মেরে আমার পেট ভরেছি। আজ সব কিছু থাকতেও তার ব্যবহার করতে পারছিনে। পারছিনে দেখতে, পারছিনে উপভোগ করতে, সেই সমুদ্র সৈকত, সেই গোল্ডেন গেট ব্রিজ, সেই তাজমহল বা নিজের অতি নিকটতম আপনজনকে।
আজ আমার আগমনের কথা শুনলে আমার সহধর্মিণী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্ত কেন? এমনতো কথা ছিল না। পরিবর্তন এসে সব কিছুর পরিবর্তন করে দিল। নাকি উহান থেকে উৎস ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে অচল করে দিল? ভাবনার বিষয়ও বটে। সাত সাগর আর তের নদী পার হয়ে সে ভাইরাস ইউরোপ, আমেরিকা ছড়িয়ে পড়ল অথচ বেজিং বা সাংহাই পৌঁছালো না বা সে দেশের রাষ্ট্রের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কিছুই হোল না! এদিকে হলিউডের তারকা থেকে শুরু করে কত লোক আক্রান্ত হচ্ছে, কত লোক মারা যাচ্ছে। সারা পৃথিবীর রেস্টুরেন্ট খালি, সাগরের কোলে কেউ নেই, শহরে ভীড় নেই। মানুষ হয়েছে মানুষের শত্রু। কারণ মানুষের মাধ্যমেই এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে বিধায় তাদের থেকে কমপক্ষে দুই-তিন মিটার দূরে থাকতে হচ্ছে। এত বড় শাস্তির পরও আমাদের চরিত্রের কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
পৃথিবী তার সৌন্দর্যে আগের মতই ভরপুর। খুব শীগগির বসন্ত তার বাহার নিয়ে হাজির হবে। অথচ আমার ঘরের বাহির হওয়া যাবে না। সেই সুন্দর পৃথিবীকে মন প্রাণ খুলে দেখা যাবে না, উপভোগ করা যাবে না, কিন্তু কেন? কী অপরাধ করেছি আমরা? আমরা কি তাহলে পৃথিবীর থেকে অভিশপ্ত?
আমি বরফের দেশে প্রায় ৩৬ বছর বাস করছি। ডিসেম্বর, জানুযারি, ফেব্রয়ারি, মার্চ মাস পার হয়ে গেল তুষারপাত দেখলাম না স্টকহোম শহরে। কী আশ্চর্য! কী কারণ তাও জানা হোলো না। হঠাৎ এক অদৃশ্য শক্তি এসে সবকিছু তছনছ করে দিল। একি বিস্ময়কর শক্তি! আমাদের তো সব ধরনের প্রস্তুতি পর্ব রয়েছে। আমরা যার যার নিজ এলাকায় বেড়া দিয়ে রেখেছি। কেউ বিনা অনুমতিতে আমাদের এলাকায় ঢুকতে পারবে না। ঢুকলেই দেহ থেকে তার মাথা পড়ে যাবে। বর্ডার গার্ড রয়েছে, পাসপোর্ট রয়েছে, স্যাটেলাইট রয়েছে। সব থাকতেও কী এমন জিনিস ঢুকলো? তাদের সংখ্যা কত? তারা দেখতে কেমন? তারা কী চায়? ডলার, পাউন্ড? নাকি অন্য কিছু? যা চাও বাবা তাই দেবো, শুধু মাফ কর। না কিছুতেই ঘুষ দেয়া যাচ্ছে না, দুর্নীতিও করা সম্ভব নয়। যাকে পারছে তাকে ধরছে, হোক না সে ইংল্যান্ডের প্রিন্স বা রহমান মৃধা, শাস্তি এক এবং অভিন্ন।
এমন ন্যায়বিচার আমরা মানুষ জাতি করতে পারিনি যা এই অদৃশ্য শক্তি করতে সক্ষম হয়েছে। তাহলে কি আমাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য এ শক্তির আবির্ভাব? তারপরও সামান্য একজন এসিল্যান্ডের কর্মচারি অথচ দিব্যি তার বাবার সমতুল্য মানুষগুলোকে কান ধরিয়ে উঠবস করাচ্ছে যা গোটা বিশ্ব দেখছে। তাহলে ভাইরাসের কী দোষ? একজন এসিল্যান্ডের কর্মচারী মনে করে সে মানুষকে জেল দিতে পারে। হাওয়া থেকে পাওয়া খবরের তদন্ত করতে পারে। তার নির্দেশে পুলিশ চলে। সে ১৪৪ ধারা জারি করতে পারে। যে ব্যুরোক্রেসির বীজ তার মধ্যে বপন করে দিয়েছে, সে বীজ থেকে অঙ্কুরিত বিষবৃক্ষের দাপট অতীতেও দেখেছি। এই দাপটের সাথে এই করোনা ভাইরাসের কোনো পার্থক্য নেই। এই অহঙ্কারের গাছ যখন উপড়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই, কিভাবে করোনা ভাইরাসকে পৃথিবী থেকে সরাবো! আমি দুই বছর ধরে লিখেছি কুশিক্ষা সম্বন্ধে। এটা কি তারই এক জলন্ত উদাহরণ? বড় সাধ জাগে নতুন করে আবার পৃথিবীকে গড়ি, পৃথিবীর সব মানুষকে আমেরিকার বিল গেটস বা কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মত দেখি। হবে কি পূর্ণ সেই মনের বাসনা? তুমি আরেক বার দয়া করিয়া দেও মোদের সেই সুযোগটি করিয়া।
রহমান মৃধা
দূরপরবাস সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com