টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর এর সাহায্যে যারা শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় তথা ট্রেডিং করেন তাঁদের জন্য এন্ট্রি/ এক্সিট সিগন্যাল পেতে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে বইটি লিখেছেন লেখক।
বইটির মূল ফোকাস হচ্ছে ইচিমুকো ক্লাউড নামক জাপানীজ টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর এর সিগন্যালকে কিভাবে শেয়ার কেনা-বেচায় ব্যবহার করা যায় তার ওপর। ইচিমুকো ক্লাউড ইন্ডিকেটর এর সাহায্যে ৫টি ভিন্ন ভিন্ন স্ট্র্যাটেজী বা কৌশলকে কিভাবে ট্রেডিংয়ে কাজে লাগানো যায় তা যথাসম্ভব সহজ ভাষায় এবং চিত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন শফিকুল ইসলাম। পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে তিনি প্রতিটি স্ট্র্যাটেজী প্রয়োগকালে কি কি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে তা স্পষ্টভাবে পয়েন্টস আকারে উল্লেখ করেছেন তিনি। তাছাড়া, প্রত্যেকটি স্ট্র্যাটেজীর ব্যাখ্যা প্রদানে তিনি চার্টের সাহায্য নিয়েছেন। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা চার্টের সাহায্যে দেখানোর কারণে পাঠকের পক্ষে মুল বক্তব্য বুঝতে অনেক সহজ হয়েছে। ফলে বইটি শেয়ার ট্রেডিং করার ক্ষেত্রে একটি কার্যকরী গাইড বইয়ে রুপ নিয়েছে।
ইচিমুকো ক্লাউড এর মত টেকনিক্যাল ইস্যু নিয়ে লেখা সত্ত্বেও বইটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে শেয়ার মার্কেটের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। বইটির মূখবন্ধে সিকিউরিটিজ একচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ফারুক আহমদ সিদ্দিকী সাহেবের কিছু কথা রয়েছে, যেখানে তিনি লেখক এবং বইটির বিষয় সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করেছেন। ভূমিকায় কেন ও কি উদ্দেশ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব বইটি লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন তা আলোচনা করা হয়েছে।
বইটিকে ১৪টি অধ্যায়ে সাজিয়েছেন লেখক। অধ্যায়গুলোর শিরোনাম হলো- (১) শেয়ার মার্কেটে কেন আপনি টাকা খাটাবেন? (২) শেয়ার মার্কেট উন্নয়নে দেশের কি লাভ? সরকারেরই বা কি করণীয়? (৩) ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল এনালাইসিসঃ কি, কেন ও কাদের জন্য?, (৪) টেকনিক্যাল এনালাইসিস এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং যত সব ইন্ডিকেটর, (৫) ইচিমুকো ক্লাউড পরিচিতি, (৬) ইচিমুকো ক্লাউড কেন অনন্য? (৭) ইচিমুকো ক্লাউড ব্যবহার স্ট্র্যাটেজী- এন্ট্রি ও এক্সিট ফর্মূলা, (৮) ইচিমুকো ক্লাউড এর নানা দিকঃ কোন্ রুপের কি অর্থ, সবলতা ও সীমাবদ্ধতা, (৯) অন্য ইন্ডিকেটর ও ইচিমুকো ক্লাউড এর সমন্বিত ব্যবহার, (১০) ইচিমুকো ক্লাউডে ডিএসই’র কতিপয় সেক্টর পর্যালোচনা, (১১) ইচিমুকো ক্লাউড দিয়ে ট্রেডিং স্ট্র্যাটেজী ব্যাকটেষ্টিং করা, (১২) সাধারন বিনিয়োগকারীর পোর্টফলিও ব্যবস্থাপনা, (১৩) কতিপয় প্রয়োজনীয় স্টক মার্কেট টার্মিনোলজি, এবং (১৪) লেখকের শেষ কথা। সবশেষে রেফারেন্স ও প্রয়োজনীয় কিছু ওয়েবসাইটের লিংক দেয়া হয়েছে।
বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে শিক্ষার প্রত্যেক শাখা উপ-শাখায় ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রসার ঘটে চলেছে। শেয়ার মার্কেট, ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রেড এবং ফিউচার ও অপশন মার্কেটের ট্রাঞ্জেকশনে সহায়তার লক্ষ্যে ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস এর পাশাপাশি শত শত টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর ডেভেলপ করেছে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির অভাবনীয় বিপ্লবের কল্যাণে আজকাল শেয়ার রিলেটেড অনেক ধরণের টেকনিক্যাল চার্ট দেখার সু্যোগ পাওয়া যায়। সেসব অসংখ্য টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর এর মধ্য থেকে লেখক কেন শুধুমাত্র ইচিমুকো ক্লাউডের উপর ফোকাস করেছেন তার ব্যাখ্যা বইয়ে তিনি নিজেই দিয়েছেন। লেখকের দৃষ্টিতে সঠিক সময়ে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় তথা এন্ট্রি-এক্সিট করার জন্য টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর এর সাহায্য অতীব দরকার। আর শত শত ইন্ডিকেটর থাকা সত্ত্বেও ইচিমুকোর মত অন্য কোনটি তেমনভাবে নির্ভরযোগ্য নয় বলেও লেখকের দাবি।
অনেক তথ্য উপাত্ত ও গ্রাফের সাহায্যে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে কেন ও কিভাবে অন্য টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর থেকে ইচিমুকো ক্লাউড বেশী নির্ভরযোগ্য এবং কিভাবে তা ব্যবহার করে সফল ট্রেডিং করা যায়। বিশেষ করে ট্রেডিশন্যাল অন্য ইন্ডিকেটরে প্রাইসের সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স লেভেল নির্ধারণে যেমন অনেকটাই অনুমান করার প্রয়োজন হয় ইচিমুকোতে সেটা করার দরকার পড়ে না। ট্রেডার তার নিজস্ব টাইমফ্রেমের আলোকে ইচিমুকোর বিভিন্ন লাইনকে সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স লাইন হিসাবে ধরার সুযোগ পেয়ে থাকেন । তাছাড়া, মার্কেট ট্রেন্ড এর দিক ও শক্তি সম্পর্কেও ইচিমুকো যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ধারণা দিতে সক্ষম মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।
লেখক বইটিতে শেয়ার ট্রেডিং বাই-সেল পাওয়া এবং তা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে যে ৫টি স্ট্র্যাটেজী অনুসরণ করার কথা বলেছেন তা হলো- (১) ট্যাংকেন সেন বা TS (৯ পিরিয়ডের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ প্রাইসের গড়) যখন কিজুন সেন বা KS (২৬ পিরিয়ডের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ প্রাইসের গড়) কে ক্রস করে, (২) প্রাইস যখন কিজুন সেন কে ক্রস করে তার উপরে বা নীচে চলে যায়, (৩) যখন কুমো ব্রেক-আউট হয়, অর্থাৎ প্রাইস ক্লাউডের ভিতর থেকে বের হয়ে উপরে বা নীচে চলে যায়, (৪) লিডিং বা অগ্রবর্তী ক্লাউডে যখন স্যাংকু-স্প্যান A (SSA) এবং স্যাংকু-স্প্যান B (SSB) এর ক্রস সম্পন্ন হয় অর্থাৎ যেটি আগে উপরে ছিল তা অপরটির নীচে চলে যায়, এবং (৫) চিক্যু-স্প্যান বা CS (বর্তমান পিরিয়ডের ক্লোজিং প্রাইস ২৬ পিরিয়ড পূর্বে বসাতে থাকলে যে রেখা তৈরী হয়) যখন প্রাইস লাইনকে ক্রস করে উপরে বা নীচে চলে যায়।
সেই ৫টি স্ট্র্যাটেজীর যে কোন একটিতে বাই এবং সেল করার ক্ষেত্রে যেসব অতিরিক্ত শর্তাদি পূরণ করতে হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। নিজের পুঁজি রক্ষা করার স্বার্থে লেখক আবশ্যিকভাবে স্টপ-লস কার্যকর করার উপর বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন। নিজস্ব ট্রেডিং স্টাইলের ভিত্তিতে ঠিক কোন্ পজিশনে স্টপ-লস করা উচিত সে ব্যাপারেও প্রতিটি স্ট্র্যাটেজী ব্যাখ্যার সময় অভিমত দেয়া হয়েছে। ইচিমুকো ক্লাউড স্ট্র্যাটেজীর একাধিক কম্পোনেন্টস একই চিত্রে থাকে বিধায় চার্টটিকে বাহ্য দৃষ্টিতে প্রথমে কিছুটা জটিল মনে হতে পারে। তদসত্বেও এর বিভিন্ন অংশের সাথে একবার ভাল্ভাবে পরিচিত হতে পারলে শেয়ার ট্রেডিংয়ে তা যথেষ্ট সহায়তা করতে পারে বলে লেখকের দৃঢ় বিশ্বাস। তাছাড়া, প্রাইস ট্রেন্ড কেমন হলে ইচিমুকো সঠিক সিগন্যাল দিবে না এবং ইচিমুকো স্ট্র্যাটেজীর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও বইয়ে বলা হয়েছে।
বইয়ের ১২ নং অধ্যায়ে সাধারন বিনিয়োগকারীর পোর্টফলিও ব্যবস্থাপনা এবং ১৪ নং অধ্যায়ে লেখকের শেষ কথা অংশে যেসব পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে তা এক কথায় চমৎকার। সেখানে অনেকগুলো বাস্তবধর্মী পরামর্শ দেয়া হয়েছে যা মেনে চলতে পারলে সাধারন বিনিয়োগকারীরা শেয়ার মার্কে্টে কখনো পাতা ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বেন না এবং মার্কেট থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে্ন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মূলত সেখানে ডিসিপ্লিনড ট্রেডিং করার জন্য যেসব শর্তাদি মেনে চলা আবশ্যক তার উপর জোর দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট অনেকটাই গুজব নির্ভর। তাই দরকার সাধারন বিনিয়োগকারীদের জন্য ফিনান্সিয়াল লিটারেসী। সে শিক্ষার মাধ্যমে ফান্ডামেন্টাল ও সঠিক টেকনিক্যাল এনালাইসিস এর ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীগণ যদি শেয়ার ক্রয় বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হন তবে আগামীতে গুজবের দাপট কমবে যার ফলে মার্কেট অনেক বেশী স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা যায়। শেয়ার মার্কেটকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্টিত করার মানসে বর্তমান সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছেন। তাঁরা প্রয়োজনীয় আইন-কানুনের সংশোধন ও তা প্রয়োগের মাধ্যমে শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। দুর্বল কোম্পানীসমূহের পরিচালনা পর্ষদ পূনর্গঠন, ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠন, দেশে বিদেশে রোড শো আয়োজন ও প্রাসংগিক নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্যাপিটাল মার্কেট উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে। সে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটকে স্থিতিশীল করার স্বার্থে সাধারন বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও আস্থার সংকট কাটাতে বইটি সহায়ক ভুমিকা পালন করতে সক্ষম।
এ বইয়ের লেখক একজন সাবেক সরকারী কর্মকর্তা। তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ নানা দপ্তর ও সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশে বিদেশে তিনি অর্থনীতি শাস্ত্রের উপর উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন এবং সেসব পড়াশুনার পাশাপাশি স্টক মার্কেট বিশ্লেষণে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এখন তিনি লেখনির মাধ্যমে তাঁর অর্জিত জ্ঞানকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উপকারে লাগাতে চান। বইটিতে বর্ণিত বক্তব্য এবং ট্রেডিং স্ট্র্যাটেজী সাধারন বিনিয়োগকারীদের ফিনান্সিয়াল লিটারেসী অর্জনে দারুনভাবে সহায়ক হতে পারে। লেখক অনেক দূর্বোধ্য বিষয়কে যথাসম্ভব সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং বইটি শেয়ার মার্কেটের বিনিয়োগকারীদে্র জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেশ সহায়তা করবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
“মেঘের আড়ালে সূর্য্যঃ ইচিমুকো ক্লাউডে শেয়ার ট্রেডিং” শীর্ষক বইটির ছাপা ও কাগজের মান অত্যন্ত উন্নতমানের হয়েছে। বইটির মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ৩৫০ টাকা যা অত্যন্ত যৌক্তিক মর্মে প্রতীয়মান হয়। বইটি ক্রয় করা কিংবা বিস্তারিত জানার জন্য লেখকের সাথে msislam86@yahoo.com ইমেইলে যোগাযোগ করা যেতে পারে।