আচ্ছা আমরা তো বাংলার মানুষ, জাতি হিসেবে আমরা কেমন? আমাদেরকে আমরা কীভাবে দেখি বা দেখতে পারি? অন্যদের কী ধারণা আমাদের সম্পর্কে? ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আমরা নিজেদেরকে কীভাবে মূল্যায়ন করে থাকি? আমাদের ভূদৃশ্য ও পুর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের কী ধারণা? আমাদের চারিত্রিক গুণাগুণ ও চেহারা সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য কী? আমাদের মরাল ভ্যালু এবং আমাদের আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে আমরা কী বলতে পারি? এসব বিষয়ে জানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতি হিসেবে, ঠিক তেমনিভাবে গুরুত্বপূর্ণ একজন পৃথক ব্যক্তি হিসেবেও।
ব্যক্তিগতভাবে জানতে হবে, আমি কে? আমি কী হতে চাই? কেন হতে চাই? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কেমন হওয়া উচিত? অর্থাৎ জাতি এবং ব্যক্তি হিসেবে নির্ধারণ করা উচিত আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য কী?
আমরা সহজেই নিজেদেরকে তুলনা করতে পারি অন্য একটি ভিন্ন দেশের সঙ্গে। তাদের মৌলিক মূল্যায়নের সঙ্গে অথবা একটি ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পকারখানার মূল লক্ষ্যের সঙ্গে। এতে পরিষ্কার যে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে তারা তাদের দক্ষতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বা নেওয়ার চেষ্টা করছে। যেমন: টেলিফোন ও কম্পিউটার কোম্পানি অ্যাপেল আইফোনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, কারণ তাদের ব্যবসার শুরু থেকে তারা তাদের নির্দিষ্ট প্রযুক্তির ওপর বিশ্বাস ও জ্ঞানকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলছে। তাদের এই সাফল্যের পিছনে কী জড়িত? তারা শুরু থেকেই তাদের নির্দিষ্ট ধারণার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল।
অন্যদিকে আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই তা হল সুইডেন, দেশ হিসাবে পাহাড় পর্বতে ভরা। ভূ-প্রকৃতি জুড়ে রয়েছে বেশ এক সুন্দর ও মনোরম দৃশ্য। দেশটিতে বেশির ভাগ সময় ঠাণ্ডা এবং বরফে পরিপূর্ণ থাকে বিশেষ করে শীতের সময়। গরমে দেখা মেলে ফুলে-ফলে ভরা এক লাল সবুজের মেলা, সেই সঙ্গে আছে হাজারও লেক। লোহা, সোনা বা আরো নানা ধরনের মূল্যবান ধাতুর খনি, রয়েছে বিশাল বন-জঙ্গল সারাদেশ জুড়ে। যার থেকে হতে পারে জ্বালানী, কাগজ বা আসবাবপত্র।
সুইডিস জাতি বেছে নিয়েছে হাই টেকনোলজি। সঙ্গে যে সম্পদ তাদের নিজেদের রয়েছে, তার ওপর তারা বেস্ট প্রাকটিস করে গড়ে তুলছে তাদের দেশ। সঙ্গে তাদের ধ্যানে-জ্ঞানে সেটাই তাঁরা চর্চা করে চলছে সেই শুরু থেকে, তার প্রমাণ আলফ্রেড নোবেল। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে এই বিশাল পাহাড়ের দেশকে যদি ঠিক মত ব্যবহার করতে না পারা যায় তাহলে সুইডেনকে বিশ্বের শীর্ষে তোলা যাবে না। তাইতো তিনি তাঁর ধ্যান ও চিন্তার সঙ্গে জ্ঞানের সমন্বয় করে গবেষণার কাজে লাগিয়েছিলেন। তাই সম্ভব হয়েছিল তাঁর পক্ষে ডিনামাইট উদ্ভাবন করা এবং যার সাহায্যে তৈরি হয়েছে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে শহর, নগর, বন্দর ইত্যাদি।
একইভাবে আর একজন উদ্যোগী আইকেয়ার (IKEA) ফাউন্ডার ইঙ্গভার কাম্প্রাদ ভেবেছিলেন কীভাবে এই বিশাল জঙ্গলকে জ্বালানী ছাড়াও মানব কল্যাণে কাজে লাগানো যেতে পারে। শেষে দেখা গেল জঙ্গলের কাঠ শুধু কাগজ আর জ্বালানীর কাজেই নয় তা নানা ধরনের আসবাবপত্রের জন্য ব্যবহার করে আইকেয়া হয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত আসবাবপত্রের কোম্পানি। আলফ্রেড নোবেল এবং ইঙ্গভার এরা দুজনই পৃথিবীর নামকরা সুইডিস দেশপ্রেমিক যাঁরা তাঁদের চিন্তায় ‘থিংক লোকালি অ্যাক্ট গ্লোবালি’ কনসেপ্ট ব্যবহার করেছিলেন এবং পরিশেষে দেখা দিয়েছিল। তাঁদের সেই ‘লোকাল কনসার্ন গ্লোবাল সল্যুশন’ যা সারা বিশ্বে প্রয়োগ করার মত এবং যা আজও উদাহরণ হিসেবে প্রচলিত রয়েছে।
আমি শিক্ষা এবং চাকুরীর সুবাদে জাপান গিয়েছি। দেখেছি তাদের দেশপ্রেম, শুনেছি তাদের মুখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। কি কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে তারা নতুন করে গড়েছে দেশটিকে নিজ চোখে দেখেছি। তাদের ধারণা যদি আবার কখনো যুদ্ধ লাগে আর শত্রুরা যদি তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে, তখন কী হবে?
বাইরে থেকে কোনও খাবার জাপানে আসতে পারবে না তখন কি হবে প্রযুক্তি দিয়ে? টয়োটা গাড়ি খাবে? কৃষক যদি না বাচে তবে কি হবে তাদের? জাপানিরাও আমাদের মত ভাত পছন্দ করে এবং তাদের নিজেদের উৎপাদিত স্টিকি ভাত যা একটার সাথে আরেকটা লেগে থাকে। হয়ত সবার আমার মত ধারণা স্টিকি ভাত কাঠি দিয়ে খেতে সহজ বলেই জাপানিরা এটা এত পছন্দ করে। না ওটা জাপানি কৃষকদের উৎপাদিত তাই এই বিশেষ ভাতের চালের দামই সেখানে সবচেয়ে বেশি।
হাজার সস্তা বা ভালো চাল আশেপাশের কোনও দেশ থেকে আমদানি করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদের চাল খাবার হিসাবে ব্যবহার করে। সরকার ইচ্ছে করেই কৃষকদের কাছ থেকে বেশি দামে কেনে যাতে করে কৃষকরা উৎপাদন ছেড়ে না দেয়। কৃষকদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকার অনেক কিছু করে। কৃষক যদি ভালো দাম না পায় তাহলে কি ওরা আর কৃষিকাজ করবে? না। কি করবে? পেশা বদলে ফেলবে।
তখন ভাবনায় ঢুকেছিল, আমরা কি আমাদের দেশের কৃষকদেরকে বছরের পর বছর উৎপাদিত শষ্যের ন্যায্য মূল্য কখনও দিয়েছি! বরং কৃষি কাজ যাতে কেও না করে সেই ব্যবস্থা করে চলছি। উল্লেখ্য জাপানিজ সরকার বছর শেষে তাদের মজুদ চাউল সাগরে ঢালে, এবং নতুন করে চাল কেনে শুধু কৃষকদের কৃষি কাজে ধরে রাখতে। শুধু কি কৃষিকাজে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের দক্ষতাকে প্রথমে কাজে লাগায়। আর আমরা কিছু হলেই, সুযোগ পেলেই, দেশ ছেড়ে বিদেশে চিকিৎসা থেকে শুরু করে এখন তো রীতিমত বিদেশি সব ব্যবহার করা শুরু করেছি!
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্নে আমাদের যে মিশন, ভিশন বা পলিসি ছিল তার গুরুত্ব জাতি হিসাবে যেমন করে পালন করা দরকার ঠিক ব্যক্তি হিসাবেও তার গুরুত্ব একই ভাবে দেখা দরকার। বাংলাদেশ যেমন কৃষি প্রধান দেশ, এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়, অনেক লোকের বসতি, মাটির উর্বরতা অনেক বেশি। এখানে কিছু খনিজ পদার্থ রয়েছে। এই সম্পদগুলো ব্যবহার করে উন্নয়ন পরিকল্পনা নজরে পড়ছে, তবে তা দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে ও দুর্নীতির কারণে সঠিকভাবে তার সুফল জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। নিজেদের যা আছে তার ওপর গুরুত্ব না দিয়ে যা নেই বা যা অন্যের উদ্ভাবন তা আমদানী করার জন্যে চলছে দৌঁড়ের প্রতিযোগিতা! যেমন দেশকে ডিজিটাল করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ডিজিটালের যুগে এটা দরকার সত্যি, কিন্তু এ কনসেপ্ট তো আমাদের নিজেদের নয়? এ তো অন্যের তৈরি বা উৎপাদন! ওটা তো অনেকটা অনুকরণ এবং অনুসরণ পদ্ধতি মাত্র। ডিজিটালাইজেশন দরকার দেশের উন্নয়নের জন্য। বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়তে হলে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়ে দূর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত, জবাবদিহিমূলক, টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, যোগাযোগ, শিল্পসহ সর্বত্র উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে এর সুফল দ্রুত জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু যদি এমনটি হয় প্রসঙ্গত ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড পেজে সজীব ওয়াজেদ জয় কোন এক সময় লিখেছেন, ‘এই মুহূর্তে আমি ট্রাফিকে আটকে আছি কিন্তু ঢাকাতে বসেই ঠিক আমেরিকার মতোই ৪জি ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছি’। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক উপদেষ্টা এবং ভিআইপি সার্ভিসের উচ্চমানের সুযোগ উপভোগকারী সত্ত্বেও তিনি যদি ট্রাফিকে আটকে থাকেন তাহলে কী দশা দেশের কোটি কোটি সাধারণ লোকের! জাতি যদি এই প্রশ্ন করে যে, ‘ট্রাফিকে আটকে ৪-৫জি ইন্টারনেট আর চিড়িয়াখানার বন্যপ্রাণীর জীবনের সুযোগ সুবিধার মধ্যে পার্থক্য কী?‘
আমরা ১৭০ মিলিয়ন বাংলাদেশি, আমাদের প্রথম চাওয়া পাওয়া হতে হবে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা, তারপর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, যোগাযোগ, সুশিক্ষা ও সু-কর্মসংস্থান এবং তা হতে হবে দেশের ক্যাপাসিটি ও ক্যাপাবিলিটির ওপর। আমাদের ব্যক্তি জীবনের এবং আমাদের ভূদৃশ্যের সকল উন্নয়ন প্রকল্পে জাতীয় সংগীতের স্পর্শ ও অনুপ্রেরণা থাকতে হবে একটি প্রতিশ্রুতি হিসেবে যে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সোনার বাংলাকে আমরা কিভাবে ভালোবাসি বা কী বুঝাতে চেয়েছি এই ভালোবাসা দ্বারা? কখনও কি ভেবে দেখেছি আমরা এটা? সত্যিকার ভাবে এই ভালোবাসার অর্থ উপলব্ধি করলে জাতির মনে হতাশা থাকার কথা নয়। কিন্তু এখনও জাতির মনে হতাশা কেন? শিক্ষাঙ্গন, রাজনীতি, অর্থনীতিতে দূর্নীতি ও অবনতি। বাবা-মার মনে দুঃখ, হতাশা, দুশ্চিন্তা কেন? কী হবে ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ? বর্তমান হতাশ ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভবিষ্যৎ হতাশ তাকে নিজেকে নিয়ে। চলছে এক হতাশার ওপর যেন আর এক হতাশা। এ এক ‘নেভার এন্ডিং হতাশা প্রক্রিয়া’।
আমার ধারণা আমাদের জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা কেন যেন নির্ধারিত হয়ে আছে জন্মের পর থেকে। যেমন জন্ম গ্রহণ মুসলিম বা হিন্দু পরিবারে, যাচাই-বাছাই ছাড়াই হতে হবে মুসলিম বা হিন্দু। বাবা-মা শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছে তাই হতে হবে শিক্ষিত। জন্মেছি বাংলাতে, তাই হতে হবে বাঙালি, দুর্নীতি সবাই করে তাই আমিও করি। স্বাভাবিকভাবে এমনটি হতেই পারে যদি আমরা না জানি আমাদের গোলস এবং অবজেকটিভস কী? সময় এসেছে ভাবার। সত্যিকার সোনার বাংলা গড়ার সুযোগ যদি না আসে তবে সুযোগ করে নিতে হবে এবং তার জন্য দরকার নিজেদের শিকড় খুঁজে বের করা, তা না হলে হবে কী গড়ে তোলা সোনার বাংলা?
জাতি হিসেবে প্রথম কাজটি যা করা হয়নি তা হলো শনাক্ত করা আমাদের পরিচয়! আমরা জাতি হিসেবে কী হতে চাই? কেন হতে চাই? এর উত্তর জানতে হবে। একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন, তারা কী চায়? তাদের দায়িত্ব বা কর্তব্য কী? আমি বাংলায় গান গাই বা বাংলায় কথা বলি তাই বাঙালি বা আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ শুধু এসব হলেই চলবে কি? আমাদের অবদান গোটা বিশ্বের দরবারে কী? তা শনাক্ত করে নিজেদেরকে গর্বিত বিশ্ব নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পৃথিবীর আর্কাইভ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে যারা নিজেদের আশা বা ইচ্ছা অনুযায়ী চেষ্টা করেছে প্রতিফলন ঘটাতে তাঁরাই পেরেছে। সবাই পড়ে তাই পড়ি, সবাই করে তাই করি, এ চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে হলে চালু করতে হবে বিশেষায়িত শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আর তা পেতে হলে দরকার জাতির মাইন্ডসেট পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণের। একই সঙ্গে জাতীয় সনদপত্রের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে ঝুঁকি নিতে বা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবার জন্য। ঝুঁকি, চ্যালেঞ্জ এবং একতাবদ্ধ বা সমন্বয় ছাড়া সম্ভব হবে না সোনার বাংলা গড়া।
দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হতে হলে দেশের সম্বন্ধে জানতে হবে আর জানতে হলে শিখতে হবে। তবেই সম্ভব হবে আলফ্রেড নোবেল বা ইঙ্গভার কাম্প্রাদের মতো নতুন চিন্তার মানুষের আবির্ভাব ঘটানো সোনার বাংলায়। সোনার বাংলায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, সোনার বাংলা গড়তে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সোনার মাটিতে ফলাতে হবে উৎপাদন যা শনাক্ত করবে জাতির পরিচয় এবং অক্ষুণ্ণ রাখবে দেশের নাম বাংলাদেশ।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com