হ্যাঁ, বাংলাদেশের সব নদীর চলার এখন অবসান ঘটেছে। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, মৃত বঙ্গবন্ধু এখন জীবিত বঙ্গবন্ধুর থেকে অনেক শক্তিশালী। কিন্তু কেউ এখনও এটা বলেনি যে মৃত নদী জীবিত নদীর থেকে অনেক গতিশীল!
আমি এবার আমার প্রাণ প্রিয় নবগঙ্গা নদীর কথা বলছি। ছবিগুলো এবং ছোট্ট ভিডিওটি দেখুন প্লিজ। পাঠিয়েছে আমার এলাকার এক ছোট ভাই, শাহজাহান মিয়া। আমার মনে হয় শুধু ক্যামেরায় নয় মনের মধ্যে যে বিবেক রয়েছে তার সেখানেও নাড়া দিয়েছে নবগঙ্গা নদীর এই করুণ অবস্থা দেখে। অথচ নাড়া দেয়নি সেখানকার প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের।
মাথাভাঙ্গা নদীর একটি শাখা, চুয়াডাঙ্গা শহরের কাছে এর উৎপত্তি। মাথাভাঙ্গা থেকে নবগঙ্গা নামকরণ করে চুয়াডাঙ্গার পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে মাগুরার কুমার ও নড়াইলের চিত্রা নদীর জলধারাসহ এটি দক্ষিণদিকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব নদীতে পড়েছে। আমার বাড়ি নহাটার পাশ দিয়ে এ নদী প্রবাহিত হয়েছে। আমার ছোটবেলার সাথী আজ সেই নবগঙ্গা নদী এখন মৃতপ্রায়! কোথাও হারিয়েছে অস্তিত্ব, কোথাও সরু খালের মতো, আবার কোথাও মাঝ নদীতে হাঁটু পানি, কিছু এলাকায় নদীর বুকে চাষাবাদও চলছে।
অবৈধ দখলদাররা স্থাপনাও নির্মাণ করছে। এতে নদীকেন্দ্রীক ইকোসিস্টেম ও আশপাশের পরিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে।
নদীর বুকে বাড়িঘর, মাছের ঘের নির্মাণসহ নানাভাবে যেন অবৈধ দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে দখলমুক্ত করে নদী পুনঃখননের দাবি এলাকাবাসীর। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নদীকে আগের রূপে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সিএস জরিপ অনুসরণ করার কথা বলছেন জেলা প্রশাসকগণ।
সেই বহু বছর ধরে শুধু আশ্বাস নয় এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে এক সময়ের খরস্রোতা নবগঙ্গা নদীকে তার হারানো যৌবন ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন এলাকাবাসী। নদী এখন খালে পরিণত হয়েছে বা বিলীন হবার পথে, অথচ নদী মন্ত্রণালয় দিব্বি চাকরী করে যাচ্ছেন যার যার জায়গা থেকে!
দেশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার মতো এককভাবে কোন প্রচেষ্টা (মন্ত্রণালয়, কমিশন, অধিদপ্তর) নেই। মন্ত্রণালয় রয়েছে, বটে তবে সমন্বয়ের ভীষণ অভাব। যার ফলে নদী সুরক্ষার চেয়ে সর্বনাশ করার মতো অনেক মন্ত্রণালয় আছে। যার যত বেশি ক্ষমতা, আনুপাতিক হারে সে তত বেশি সর্বনাশ করছে নদীগুলোর। ফলে মাঝে মধ্যে কেউ নদী সুরক্ষার তাগিদ দিলেও তা বাস্তবায়নে কোনো তৎপরতা কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অথচ টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি আমাদের প্রয়োজন সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে নদীকে তার হারানো গৌরব ও যৌবন যে ফিরিয়ে দিতে হবে সেটা কেউ এখনও বুঝতে চেষ্টা করছে না।
নদী আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। নদীর ব্যবহার বহুমাত্রিক, যখন যেভাবে যার প্রয়োজন, তখন সেভাবেই নদীকে তারা ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছোট এই দেশের মধ্য দিয়ে ছোট-বড় সাতশর মতো নদী বয়ে গেছে। মানুষের জীবন-জীবিকা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি সবকিছুই নদীর ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।
নদী আমাদের সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থেই নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নদী ও পরিবেশ রক্ষা করে আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর এসবের জন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও তরুণ প্রজন্মের ঐক্যের মধ্য দিয়ে নদী রক্ষা করতে হবে। নদী ভাঙন দেশবাসীর জন্য মহাসংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার নদী রক্ষার দায়-ভার এড়াতে পারেন না।
উপজেলা ও জেলায় ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের। এই দুই কর্মকর্তা উপজেলা ও জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি। কেউ অবৈধভাবে নদী দখল, দূষণ, পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করলে এ দুই কর্মকর্তার তা বন্ধ করার কথা। এমনকি নদী থেকে কেউ অবৈধ বালু উত্তোলন করলেও তা বন্ধ করা তাঁদের দায়িত্ব। ইউএনও ও জেলা প্রশাসকেরা কখনো অনিচ্ছায়, কখনো নেতাদের চাপে, কখনো কাজের ভারে তা যথাযথভাবে পালন করেন না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত কিন্তু তাদের সে সময় নেই।
অনেক নদী খনন করা হচ্ছে তবে খননের সময়ে কোনো নদীর প্রকৃত প্রস্থ মেপে দেখার প্রয়োজন কেউ মনে করছে না। আবার অনেক নদীকে খাল হিসেবেও খনন করা হচ্ছে কিন্তু কেন? উত্তর নেই। দেশে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় রয়েছে, তিনারা আবার সব নদীতে কাজ করেন না। তাদের কাজও সামগ্রিকভাবে নদীবান্ধব নয়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কোনো নদীর ওপর দিয়ে যখন সড়ক তথা সেতু নির্মাণ করে, তখন নদীর প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক ছোট করে সেতু নির্মাণ করে। আর অবৈধ দখলদারেরা সেতুর মাপ ধরে নদীর প্রস্থ চিহ্নিত করে। নদীর সর্বনাশকারীরা এভাবে নদীর সর্বনাশ করে চলছে অথচ কোথাও কেউ নেই সেটা দেখার! প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় এত বড় সর্বনাশ হওয়ার পরও কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
কিন্তু কেন? যদি কোনো সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, সাব-রেজিস্ট্রার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, প্রকৌশলী, মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করা হয় তবে দেশকে দেশের নদীকে রক্ষা করা যাবে না। আইনে ফাঁক রয়েছে, ক্ষমতায় দুর্নীতি রয়েছে যার ফলে সবাই এই অপরাধ করেই চলেছে। নদীর স্বার্থ রক্ষায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যথেষ্ট সচেতন হবার কথা কিন্তু কী করছেন তারা?
প্রতিটি জেলায় নদী রক্ষা কমিটি রয়েছে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে। নদী ভরাট ও অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি নদী খননের প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন ও নদী রক্ষায় নানা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করাও দরকার। কিন্তু শুধু জেলা প্রশাসন অথবা পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী বাঁচাতে পারবে না। এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
সর্বোপরি সরকারকে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সবার জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে।আমাদের দেশের সব নদীই এখন দূষিত। দূষিত নদী পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কার্যকর কী ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন? খুব জানতে ইচ্ছে করে! বর্তমানে প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা নদী দখল করছে।
স্থানীয় প্রশাসক, রাজনীতিক, ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা অনেক সময় জোটবদ্ধ হয়েও নদীর সর্বনাশ করছে। বিশেষ করে কোথাও নদী উদ্ধারে সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলে দলমত-নির্বিশেষে অবৈধ দখল বজায় রাখার স্বার্থে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লুটপাট করছে। নদীর সর্বনাশকারীরা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের এত বড় সর্বনাশ করার পরও কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
সব মন্ত্রণালয়ের জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে যে ভাবে কাজ করার কথা, দেশ স্বাধীন হবার এত বছর পরও সেটা তেমন চোখে পড়ছে না। পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার পর দেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তোলার যে গুরুদায়িত্ব অনেকই পেয়েছেন তা শুধু অবহেলা, অনাদর, অসম্মানের সাথে হারিয়ে ফেলা হচ্ছে। জীবনে এ সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে কিনা জানি না, তবে এসেছিল জীবনে একবার!!
সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন যদি থেকেই থাকে তবে নদী সুরক্ষায় এমন অবহেলা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। নদী-প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে বাংলার মানুষ ভালো থাকতে পারে না, পারবে না। চরম বিপদে পড়ে একদিন সব ধ্বংস হয়ে যাবে তেমন একটি সময়ের জন্য অপেক্ষা না করে আসুন নদী রক্ষা করতে শুরু করি। আর দেরি নয়, আর দুর্নীতি নয়, এবার দেশের কথা ভাবুন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, বুড়িগঙ্গা, নবগঙ্গা ছাড়া সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়। সোনার বাংলা গড়ার চেষ্টা যত বিলম্বে হবে, ততই সর্বনাশ হবে নদীর। একটু নাটকীয় ভাবে লিখাটি শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষটি যে এত বড় ট্রাজেডিপূর্ণ হবে ভাবতে পারিনি!
লেখক:রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com