মাত্র ১০ মাস মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় শিশু পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। তারপর এক বছর সময় মায়ের সান্নিধ্যে জীবনের পূর্ণাঙ্গতা লাভ করতে শুরু হয়। মা-বাবা, ভাই-বোন, পরিবার—সব মিলিয়ে জীবনের যাত্রা শুরু হতে থাকে। জন্ম থেকে যাত্রা শুরুর সময়টুকু বাকি জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টুকু এত গুরুত্বপূর্ণ যে আমার জীবনের ৩৭ বছর হার মেনেছে সেই বাংলাদেশের ২০ বছরের কাছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আছে কি তেমন পার্থক্য, মাতৃগর্ভ থেকে বের হওয়ার পর মাতৃভূমিতে বসবাস আর জন্মের পরপরই মা-বাবাকে ছেড়ে পালিত সন্তান হয়ে অন্য দেশে বসবাসের মধ্যে? সুইডেনের একটি শহর, নাম স্ট্রেংন্যাস। সেখানে আমরা বসবাস করেছি সাত বছর। মাইকেল ও লেনা আমাদের প্রতিবেশী, ভালোবেসে বিয়ে করেছে। দুজনেই সন্তানের বাবা-মা হতে বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষে নানা ধরনের চেকআপ শুরু করে এবং সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে জানতে পারে লেনার গর্ভে সন্তান হবে না। কি করা? পরে সিদ্ধান্তে আসে যে তারা সারোগেট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান নেবে। মাইকেল তাঁর স্পার্ম দেবে ভারতে এক নারীকে। সারোগেট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং অর্থের বিনিময়ে অনেক দরিদ্র দেশের নারীরা গর্ভধারণ এবং সন্তান প্রসব করে থাকেন। শর্ত ছিল, গর্ভধারণ থেকে প্রসব করা এবং তিন মাস ভারতের সারোগেট মায়ের সঙ্গে থাকবে। পুরো ১৩ মাসের সব খরচ এবং এককালীন কিছু অর্থের বিনিময়ে এ কাজ সম্পন্ন হয়।
এ ১৩ মাসের ভেতরে মাইকেল ও লেনা দুইবার ভারতে বেড়াতে গিয়েছে এবং সারোগেট মায়ের সঙ্গে দেখা করেছে। পরে সেই তিন মাস বয়সের মেয়েকে তারা সুইডেনে নিয়ে আসে। মেয়ের নাম সিসিলিয়া। সিসিলিয়া দেখতে বাদামি রঙের হয়েছে। জন্মের তিন মাস থেকে শুরু করে আজ ২০ বছর বয়স অবধি সিসিলিয়া পরিপূর্ণ সুইডিশ। বলতে গেলে তার খাওয়া থেকে শোয়া—সব কিছুতেই সুইডিশ সংস্কৃতি জড়িত। সব কিছুতেই সিসিলিয়া ন্যাচারাল সুইডিশ, তবু সে দেখতে সুইডিশদের মতো নয়। এমনকি তার মায়ের সঙ্গে সে কিছুতেই মিল খুঁজে পায় না।
বাবার প্রতি সে যেমনটি ন্যাচারাল, মায়ের প্রতি তেমনটি না। সিসিলিয়া প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, যখন তার বয়স চার থেকে পাঁচ বছর। সিসিলিয়ার বাবা-মা নানাভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করতে করতে এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে সিসিলিয়া এখন পুরো বিষয়টি সম্পর্কে অবগত।
সিসিলিয়ার ভাবনায় ঢুকেছে সে ইন্ডিয়া যাবে এবং খুঁজে বের করবে তার গর্ভধারিণীকে। এরই মধ্যে ২০ বছর পার হয়েছে। মাইকেল ও লেনার সঙ্গে সেই ভারতীয় সারোগেট নারীর কোনো যোগাযোগ নেই। তা ছাড়া সেই ভারতীয় মা শুধু মাইকেল নয়, আরও কয়েকটি দেশের পুরুষের স্পার্মে গর্ভবতী হয়ে বাচ্চা প্রসব করেছেন।
এটা ছিল সেই ভারতীয় নারীর পেশা। সিসিলিয়া তার বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরেছে তাঁরা যেন তার সেই গর্ভধারিণী মাকে খুঁজে বের করেন। আমাদের মেয়ে জেসিকার বয়স ২০ বছর। জেসিকার জন্ম হয় স্ট্রেংন্যাসে। স্ট্রেংন্যাস স্টকহোম থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। সিসিলিয়া ও জেসিকা কিন্ডারগার্টেনে একসঙ্গে কাটিয়েছে।
তারপর আমাদের বাড়িও ছিল বেশ কাছাকাছি, সব মিলে অনেক দিনের চেনাজানা তাদের সঙ্গে। মাইকেল ধরেছে আমাকে, কীভাবে কী করবে তা নিয়ে। এদিকে দিল্লি থেকে সুইডিশ দূতাবাস মাইকেলকে জানিয়েছে মহিলা মারা গেছেন বছর দুই আগে।
আমি আমার মতো করে বোঝাতে চেষ্টা করাতে সিসিলিয়া আমাকে প্রশ্ন করেছে, তুমি সুইডেনে এত বছর আছ, তারপরও কেন বাংলাদেশেকে নিয়ে ভাব? আমি বলেছি, দেখ আমি ২০ বছর থেকেছি সেখানে আর তুমি ১৩ মাস, পার্থক্যটা অনেক। আমি এও বলেছি যে আমার মেয়ে জেসিকাও কিন্তু তোমার মতো দেখতে। সিসিলিয়া উত্তরে বলল, হ্যাঁ, তবে সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে জীবন যাপন করছে। আমি বললাম, তুমিও তো তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে জীবন যাপন করছ। সিসিলিয়া অ্যাগ্রি, তারপরও সে ডিজঅ্যাগ্রি। বলে তুমি বুঝতে পারছ না আমার অনুভূতি! তার অনুভূতিতে সে মনে করে লেনা তার আসল মা নয়, যদিও সিসিলিয়া ভালোবাসে লেনাকে মায়ের মতোই। এদিকে বেচারি মা লেনা হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে তার মেয়ে সিসিলিয়াকে। লেনা তার মেয়ের অনুভূতির কথাটাও অনুভব করে।
মাত্র ১৩ মাস, কী এমন জাদু রয়েছে সেই ইন্ডিয়ান মায়ের মধ্যে, যা সিসিলিয়া দিনের পর দিন শুধু মিস করছে! সিসিলিয়ার সব থাকতেও মনে হচ্ছে তার কিছু নেই। জন্মসূত্রে সিসিলিয়ার জন্মভূমি ও মাতৃভূমি এক এবং অভিন্ন। কারণ দীর্ঘ ১৩ মাস সময় তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। যে সময়টিতে সে তার সারোগেট মায়ের সংস্পর্শ পেয়েছে। আমার ও সিসিলিয়ার অনুভূতির মধ্যে রয়েছে বিরাট তফাত। আমার সম্পর্ক বাংলাদেশের সঙ্গে জন্মভূমি, মাতৃভূমি এবং জন্মের শুরু থেকে ২০ বছর অবধি।
সিসিলিয়ার জন্মসূত্রে মাতৃভূমির সংস্পর্শ রয়েছে জীবনের শুরুতে, তাই হয়তো তার ভাবনায় পুরো ইন্ডিয়া নয়, শুধু তার গর্ভধারিণী তার কাছে বড় আকারে প্রভাব বিস্তার করেছে। সিসিলিয়া তার গর্ভধারিণীকে দেখতে পাবে না, তা সে মেনে নিতে শুরু করেছে। আমি আমার ধ্যানে, জ্ঞানে এবং স্পর্শে ধরে রেখেছি বাংলাদেশকে। তাই এত বছর বিদেশে থাকা সত্ত্বেও জন্মেসূত্রের অনুভূতিটাই প্রভাব বিস্তার করেছে আমার জীবনের ওপর।
সুইডেনের প্রতি হয়েছে এবং রয়েছে দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলাদেশের প্রতি রয়েছে ঋণ, যা শুধু ভালোবাসার ঋণ, তাই তো যেখানে ভালো কিছু দেখি, বারবার ভাবি আর ফিরে তাকাই সেই মাতৃভূমির দিকে। জোটে যদি মোটে দশটি টাকা জমাবার তরে, পাঠাতে মন চায় বাংলাদেশের ঘরে। ছোটবেলার সব স্মৃতি, যা শুধু মনে করিয়ে দেয় হৃদয়ের ভালোবাসা আর মায়ের সেই স্নেহ ও প্রীতি।
মাইকেল ও লেনা সিসিলিয়াকে কথা দিয়েছে কোনো এক সময় ইন্ডিয়াতে বেড়াতে নিয়ে যাবে। দেখা হবে না মাকে, তবে দেখবে তার মাতৃভূমিকে। মা-বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা বা সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা রয়েছে সত্যি, তবে পার্থক্য রয়েছে অনুভূতির এবং তা নির্ভর করে সন্তানের জন্মসূত্রের ওপর, যেমন বায়োলজিক্যাল, সারোগেট প্রক্রিয়া বা পালিত সম্পর্ক।
সিসিলিয়ার ভালোবাসায় রয়েছে বায়োলজিক্যাল অনুভূতির দুর্বলতা। আর আমার ৩৭ বছর বাংলাদেশ ছেড়ে দূর পরবাসে থাকা অনুভূতিতে রয়েছে ভালোবাসার দুর্বলতা। কারণ I am not living with my power, I am living with the help of power and this power is so wonderful and powerful to our humanity.
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com