গতকাল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) কার্যালয়ে এক আলোচনায় এ অভিমত উঠে আসে।
এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘হাউ ডু উই রেসপন্সিবলি ওপেন লজিস্টিকস, রিটেইল, এগ্রিকালচার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরস মিনিমাইজিং কভিড-১৯ হেলথ কেয়ার রিস্কস?’ আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এমপি, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ড. রুবানা হক, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবির, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সায়ফুল ইসলাম ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনায় অংশ নেন বিভিন্ন জেলার চেম্বার সভাপতিরা।
আলোচনায় অংশ নেয়া সব খাতের প্রতিনিধিরা নিজ নিজ খাতের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ে আলোকপাত করেন। ডিজিটাল মাধ্যমে আলোচনায় যুক্ত হওয়া জেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ী নেতারা বন্দর কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহ ঘাটতির তথ্য জানান। রমজান উপলক্ষে রেস্টুরেন্টগুলোর পার্সেল সার্ভিস চালু করার পক্ষে মত দেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দৈনিক ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে বলে জানান পরিবহন খাতের প্রতিনিধিরা।
সভায় রফতানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধাপে ধাপে কারখানা কার্যক্রম শুরু না করলে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ভবিষ্যৎ ব্যবসাও প্রতিযোগী অন্যান্য দেশ নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আলোচনায় ব্যবসায়ীরা বলেন, অর্থনীতি বাঁচাতে কারখানা খোলার বিকল্প নেই। তবে তা করতে হবে ধাপে ধাপে সীমিত পরিসরে।
শুধু কারখানা খুললেই চলবে না, বাড়াতে হবে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি ও করোনার পরীক্ষাও। তারা বলেন, চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো এ মুহূর্তে তাদের রফতানিমুখী শিল্প খুলে দেয়ার বিষয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, অর্থনীতিকে বাঁচাতে দেশের শিল্প-কারখানা বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্তের আলোকে পর্যায়ক্রমে খুলে দিতে হবে। আমাদের অর্থনীতির কী পরিমাণ ক্ষতি হবে এবং আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটুকু আছে, সেসব বিষয় পর্যালোচনা করে অতিসতর্কতার সঙ্গে কলকারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারা পৃথিবী ঝুঁকির মধ্যে আছে। জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশ করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে থাকার পরও তাদের প্রধান শিল্প খাত ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে। এফবিসিসিআইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন খাত পর্যালোচনা করে আমাদেরও পদক্ষেপ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে এফবিসিসিআইকে একটি গাইডলাইন তৈরি করে সরকারকে দেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, শিল্প ও দেশের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে লাল, হলুদ ও সবুজ রঙে চিহ্নিত করে বিভাজন করা জরুরি। সেক্ষেত্রে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও অন্যান্য সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে খাতভিত্তিক হেলথ প্রটোকল নির্ধারণ করে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, এফবিসিসিআই অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আইএলও এবং অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সম্ভাব্য হেলথ প্রটোকল মেনে কীভাবে দেশের শিল্প-কারখানা ধীরে ধীরে খুলে দেয়া যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছে সরকার।
ঢাকার বাইরের পোশাক শ্রমিকদের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে না আসার অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, কারখানার আশপাশের শ্রমিক দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। যেসব শ্রমিক আসবেন না, তাদের বেতন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চলে যাবে।
এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনীতি সচল রাখতে হবে। এলাকাভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
নোয়াব সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ৬৪ জেলায় করোনা টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাত এগিয়ে আসতে পারে। প্রণোদনার প্যাকেজের শর্ত শিথিল করতে হবে। না হলে এপ্রিলের বেতন নিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যাবে। এছাড়া বিজ্ঞাপন বাবদ সরকারের কাছে সংবাদপত্রের পাওনা টাকার বিষয়েও উল্লেখ করেন তিনি।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ বলেন, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সবার আগে খুলে দিতে হবে। রেল ও নৌপথ ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন হলে চাপ কমবে।
দেশের প্রাচীর বাণিজ্য সংগঠন এমসিসিআইয়ের সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা যেন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ না দিই। এখন আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পোশাক শিল্পের ৮৫৬টি কারখানা খুলে দেয়ার দাবি আছে বলে জানান বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন ডলারের ওপর অর্ডার বাতিল হয়েছে। আমাদের ওপর কারখানা খুলে দেয়ার চাপ আছে। অনেকের অর্ডার আছে। এলাকাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে, দিনক্ষণ বেঁধে, সীমিত আকারে ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করে কারখানা খুলে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তিনি সবার সহযোগিতা চান। এছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে যদি অর্ডার চলে যায়, তাহলে তা ফেরত আনা কঠিন হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
চলতি মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত কোনো প্রকার জরিমানা ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যেন পণ্য খালাস করা যায়, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি জানান চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, শিপিং এজেন্টদের অফিস বেলা ১টা পর্যন্ত খোলা থাকায় কাগজ তৈরিতে বিলম্ব হচ্ছে এবং তাতে জরিমানা গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
শিপিং অফিস বেলা ৩টা পর্যন্ত খোলা রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা শুধু রমজান মাসে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে থাকেন। কিন্তু এবার সে সুযোগ নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কীভাবে তাদের ব্যবসা পর্যায়ক্রমে খুলে দেয়া যায়, সে ব্যাপারে একটি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।