তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬৫ হাজার কোটি ডলার ব্যবহারের অধিকার সীমিত করা। আর এই ঘটনাকে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে।
রিজার্ভ দুইভাবে কাজ করে। প্রথমত, এটি একধরনের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। কারণ, যাঁরা কোনো দেশকে অর্থনৈতিক আক্রমণের কথা ভাবছেন, তাঁরা যদি জানেন যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তা মোকাবিলা করার সক্ষমতা আছে, তবে তাঁরা দুইবার চিন্তা করবেন। রিজার্ভ যত বড় হবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে তা ব্যবহার করার বাস্তবতা তত কমবে।
দ্বিতীয়ত, রিজার্ভ বেশি থাকল কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাবাজারে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিষয়টি হলো, ৬৫০ বিলিয়ন ডলার রুবলে রূপান্তরিত করতে পারলে এবং রুবলের বিনিময়ে ডলার, ইউরো বা পাউন্ড বিক্রি করলে রুশ মুদ্রার মূল্যবৃদ্ধি পেত।
কিন্তু রাশিয়ার পক্ষে এখন কিছুই করা সম্ভব নয়। ৬৫ হাজার কোটি ডলারের কতটা হিমায়িত করা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে অনেকেরই ধারণা, রাশিয়া এই অর্থের কিছুই ব্যবহার করতে পারবে না, অন্তত যত দিন অবরোধ না ওঠে। তাদের রিজার্ভের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি, অর্থাৎ ৪৬ হাজার কোটি ডলার বিদেশি মুদ্রা বা সিকিউরিটিজে রাখা হয়েছে, যার কিছুই এখন মস্কোর আওতায় নেই। বাকি যা আছে, তার বেশির ভাগই স্বর্ণ হিসেবে রাখা হয়েছে, যেগুলো রাশিয়ারই বিভিন্ন ভল্টে রাখা হয়েছে। পুতিন হয়তো ছাড় দিয়ে এই স্বর্ণ কেনার জন্য কাউকে খুঁজে পেতে পারেন। তবে শিগগিরই তা নগদ অর্থে রূপান্তর করার সম্ভাবনা কম।
নিষেধাজ্ঞার ফলে রুবল হঠাৎ করেই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং গত সপ্তাহে মার্কিন ডলারের বিপরীতে তার মান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি ভিত্তিতে সুদের হার ২০ শতাংশ বৃদ্ধি না করলে এবং দেশ থেকে অর্থ নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা না দিলে বা পরিকল্পিতভাবে মূলধনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করলে তা আরও কমে যেত।
দ্য গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আঘাত হারে হারে টের পাওয়া যাবে। দুর্বল মুদ্রার কারণে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। এর সঙ্গে বেড়ে যাবে ঋণের খরচ। তাতে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব আরও গভীরভাবে অনুভূত হবে এবং অর্থনীতিকে গভীর মন্দার মুখে পড়বে। সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ কনসালটেন্সির অর্থনীতিবিদ কে নিউফেল্ড দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, দুই বছরের মধ্যে রুশ অর্থনীতি ১৪ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে, যুদ্ধে না জড়ালে অর্থনীতির আকার যেমন হতো, তার তুলনায়। এতে অনেক মানুষের চাকরি চলে যাবে, আমদানি পণ্যের ঘাটতি দেখা দেবে, সঞ্চয়ের মূল্য কমে যাবে।
এদিকে শুধু রাশিয়া নয়, এই আঘাত সবার গায়েই লাগবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ‘ধ্বংসাত্মক’ প্রভাব পড়তে পারে বলে শুক্রবারই সতর্ক করেছেন বিশ্বব্যাংকের কর্ণধার ডেভিড ম্যালপাস। আর শনিবার একই কথা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রথম উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গীতা গোপীনাথের বক্তব্য, এই যুদ্ধের জেরে জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির জেরে বাড়বে বিভিন্ন দেশে জীবনযাপনের খরচ। এতে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো বিপাকে পড়বে বলেই তাদের আশঙ্কা।
দুই বছর ধরে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করছে বিশ্বসম্প্রদায়। করোনা রুখতে যে লকডাউন দেওয়া হয়েছে, তার জেরে বিশ্ব অর্থনীতি এমনিতেই কয়েক বছর পিছিয়ে দিয়েছে বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর এবার শুরু হয়েছে যুদ্ধ, যা আগামী দিনে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়বে কি না, সেই উদ্বেগও আছে।
গীতার মতে, উন্নয়নশীল দেশে শুধু জ্বালানি ও খাদ্যের চাহিদা বেশি তা-ই নয়, এর পেছনে খরচও বেশি। যেমন পৃথিবীতে গড়ে চাহিদার ৩০ শতাংশ হলো জ্বালানি ও খাদ্য। সেখানে আফ্রিকা মহাদেশের ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশ। তার অনেকটাই আমদানি করতে হয়। আবার উন্নত দেশগুলোতে মোট খরচের ১০ শতাংশ হয় এই দুইয়ের পেছনে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা ২৫ শতাংশ ও কম আয়ের দেশগুলোতে ৫০ শতাংশ।