দ্রুত শিল্পায়ন, উন্নত শিক্ষা ও সুশাসনের মাধ্যমে মাত্র দুই দশকেই উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নাম লেখায় মালাক্কা প্রণালীর মুখে অবস্থিত ৬৯৭ বর্গকিলোমিটারের ক্ষুদ্র এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি। অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুবিধা, উন্নত প্রযুক্তি, মেধাসম্পন্ন মানবসম্পদ থাকায় সিঙ্গাপুর বিশ্বের শত শত শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক কোম্পানীর এশিয়ান হেডকোয়ার্টারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ ঘণবসতিপূর্ণ দেশ হয়েও ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার ও কঠোর পরিবেশ আইন পরিপালনের কারণে এটি এখন বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে। নাগরিকরা আইনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, আমলা ও সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি প্রায় শুন্যের কোঠায়।
পর্যটনে দেশটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন পর্যটক এখানে আসেন ভ্রমণে। ছোট্ট এ নগর রাষ্ট্রে রয়েছে চীনের সাংহাই এর পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবন্দর এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিমান ভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মানব সম্পদ উন্নয়নে সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম সেরা রাষ্ট্র। নগর রাষ্ট্রটি অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতায় আমেরিকা ও হংকংয়ের পরে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বিশ্বের সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালে দেশটির মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৫৯৫৯০ ডলার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত চিকিৎসা সেবা নিতে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মানুষ এখানে আসে। আব্দুল করিমও এখানে এসেছে তার বন্ধুর চিকিৎসার জন্য।
এত অল্প সময়ে দেশটি এত উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব হলো? এসব ভাবনা মাথায় নিয়ে সিগারেট ফুঁকছিলেন আব্দুল করিম। হোটেলের কাছে পৌঁছে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে পাশের সড়কদ্বীপের একটা ফুলের টবে ফিল্টারটা ছুঁড়ে দিলেন। সাথে সাথে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে পুলিশ এসে হাজির। আপনি পরিবেশ নষ্ট করেছেন। দু‘শ ডলার জরিমানা করা হলো। পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় পরিশোধ করার জন্য সময় দেয়া হলো। দেশে ফিরে আসার পর গল্পটি বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব মোঃ আব্দুল করিম। - আপনি তো দেশে ফিরে এসেছেন তাহলে এখন জরিমানা না দিলেও চলবে। বললেন, জরিমানা না দিলে আমার পাসপোর্ট কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। আর কখনও আমার সিঙ্গাপুরে প্রবেশের অনুমতি মিলবে না।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাজপথ দিয়ে হাটার সময় শুধু সিগারেটের ফিল্টার নয় কলার খোসা, চকোলেট, চিপস, বিস্কুট, চানাচুরসহ সকল খাবারের প্যাকেট রাস্তার মাঝখানে ফেললেও কেউ প্রতিবাদ করেনা। যত্রতত্র সকল প্রকার ময়লা আবর্জনা ফেলে নোংরা করা হচ্ছে পথঘাট ও পরিবেশ। ব্যবহৃত মেডিকেল বর্জ, স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্যাম্পার্স, নানা ধরণের পুরোনো পোষাক জানালা দিয়ে পাশের ড্রেনে, রাস্তায়, সুয়ারেজ লাইনের মুখে যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। ভাঙ্গা কাচের টুকরো, পুরোনো আসবাবপত্র, কাগজ, পলিথিন, ফলমুলের খোসা, তরকারির খোসা, বাসি খাবার সবই একসাথে ময়লার ঝুড়িতে, রাস্তার পাশে ফেলা হচ্ছে। গলির রাস্তায় বিভিন্ন প্রকার পোকামাকড়, মশামাছি ভনভন করছে নানান রকম ফলের পঁচা খোসার উপর দিয়ে। যত্রতত্র মলমুত্র ত্যাগ করছে নগরের পথচারি, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, পথশিশু ও বস্তির শিশুরা। রাস্তায় পড়ে থাকা সুয়ারেজের ময়লা শুকিয়ে ধুলা বালুতে পরিণত হচ্ছে, গাড়ির চাকার সাথে মিশে বাতাসে উড়ছে সেসব বিষাক্ত ধুলা। প্রবেশ করছে আমাদের ফুসফুসে। ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষণের শহর।
পাশের নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলা সকল প্রকার ময়লার পঁচা পিচ রঙের নোংরা পানির গন্ধ বাতাস ভারি করে তুলছে। সরু সুয়ারেজ লাইন আর ড্রেনেজ লাইনে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, সোলাসহ পানিতে অদ্রবনীয় সকল প্রকার ময়লা জমে পানি যাওয়ার লাইন প্রায় বন্ধ। কোথাও কোথাও ম্যানহোলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে মলসহ নোংরা পানি। ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। ময়লা জমে সুয়ারেজ লাইনের মুখ বন্ধ থাকা এবং সরু লাইনের কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরের রাস্তায় জমে যায় হাটু-কোমর-বুক পানি। নর্দমার নোংরা-ময়লা বৃষ্টির পানিতে মিশে যায়। খানাখন্দ ভরা প্রধান সড়ক সহ সকল অলিগলি। ঢাকনা খোলা ম্যানহোল। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে চলে নগরবাসীর বসবাস ও চলাফেরা। এমন পরিবেশে ছড়াচ্ছে কলেরা, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুসহ নানা ধরনের রোগব্যাধি। ভুগছে নগরবাসী। বলতে গেলে নিজেরাই নিজেদের ভোগান্তির সকল আয়োজন করছি। গত এক বছরে চট্টগ্রামে ঢাকনা খোলা ম্যানহোলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ ক’জন।
আমাদের পরিবেশ বিষয়ক আইন থাকলেও তা যথাযথ পরিপালনের ও প্রয়োগের অভাবে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়ছে। সর্বশেষ গত ৪ জুন রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে কন্টেইনার ডিপোতে অবৈধভাবে কেমিক্যাল রাখার ফলে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৪৯ জন প্রাণ হারায়। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় এ ধরণের কেমিক্যাল কারখানায় অগ্নিকান্ড নিকট অতীতে বেশ কয়েকটি সংঘটিত হয়েছে যাতে প্রাণ হারিয়েছে অনেক মানুষ। পরিবেশ আইন পরিপালন করা হচ্ছে না বেশিরভাগ গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানায়। অতীতে গার্মেন্টস কারখানায় আগুন এবং ভবন ধ্বসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে অনেক কর্মী। এ ধরণের ঘটনা সবই পরিবেশ আইন অবমাননার ফলাফল। এর বাইরে কল কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বর্জ বাতাস ও পানি দুষিত করছে। হুমকিতে পড়ছে পরিবেশ ও প্রাণীকূল।
২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। এজন্য প্রয়োজন - শিল্পোন্নয়ন, পরিপক্ক এবং পরিশীলিত অর্থনীতি, উচ্চ জিডিপি ও প্রকৃতভাবেই বাসিন্দাদের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি, উন্নত প্রযুক্তিগত অবকাঠামো, উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসম্মত উচ্চ শিক্ষার সুযোগ। উন্নত দেশের জন্য প্রয়োজন টেকসই উন্নয়। উন্নয়নকে টেকসই করতে প্রয়োজন উন্নত নৈতিকতাসম্পন্ন ও প্রশিক্ষিত মানব সম্পদ।
নাগরিক জীবন ও পরিবেশ উন্নয়নে জনগণের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক সভা, সেমিনার, প্রকাশনা ও সচেতনতামূলক প্রচারণা বৃদ্ধি করা সময়ের দাবী। পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি জনগনকেও নিজেদের সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দেশ ও পরিবেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
রিয়াজ উদ্দিন : লেখক ও ব্যাংকার