সোমবার প্রকাশিত রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ১৪৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। যা তার আগের মাস এপ্রিলে এই রফতানি পরিমাণ ছিল মাত্র ৫২ কোটি ডলার।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অর্থবছরের মে মাসের চেয়ে চলতি অর্থবছরের মে মাসে রফতানি আয় কম হয়েছে প্রায় ৬১ শতাংশ। গত এপ্রিলে কমেছে ৮৩ শতাংশ। আগামী মাসগুলোতেও রফতানি আয়ে এই নেতিবাচক প্রবণতা কমে আসবে বলে আশা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, করোনার কারণে ১ হাজার ১৫০ কারখানার ৩১৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। ৪৬০ কোটি টাকা মূল্যের হিমায়িত চিংড়ির ২৯৯টি ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল করেছে বিদেশি ক্রেতারা। দুই মাস ধরে সবজি রফতানি বন্ধ। আসবাবে নতুন কোনো ক্রয়াদেশ আসছে না।
আর চীনের কারণে গত জানুয়ারিতে প্রথম চামড়া খাতেই বিপর্যয় নেমেছিল। ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনা জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের পণ্য রফতানি খাত টালমাটাল হয়ে পড়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে সংকট ততই বাড়ছে। রফতানি আয় ধারাবাহিক কমছে। কাজ না থাকায় কারখানাও বন্ধ হচ্ছে। শ্রমিকদের চাকরি হারানোর শঙ্কা বাড়ছে। করোনায় আক্রান্তের এই সময়ে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে রফতানি খাত।
ইপিবির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের মে মাসে দেশের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪১০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ সময় আয় হয় মাত্র ১৪৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মে মাসের চেয়ে এই আয় ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৬৪ দশমকি ৩৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের এই সময় আয় ছিল ৩৮১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
উদ্যোক্তারা জানান, করোনার প্রভাবে আগের মাস গত এপ্রিলে স্মরণকালের সবচেয়ে কম আয় হয়েছে। এপ্রিলে মাত্র ৫২ কোটি ডলার রফতানি আয় অর্জিত হয়। আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮৩ শতাংশ আয় কমেছে এপ্রিলে। মার্চে কিছুটা কম আসলেও সে মাসে করোনার প্রভাবটা পুরোপুরি বোঝা যায়নি।
এ কারণে রফতানি হ্রাসের হারটা ছিল মোটামুটি সহনীয়। রফতানি কম ছিল ১৮ শতাংশ। তবে বিশ্ববাজারে করোনার হানা বাংলাদেশের আগেই শুরু হয়ে হওয়ায় ফেব্রুয়ারি ও মার্চ থেকেই রফতানি আদেশ কমতে শুরু করে। মার্চে নতুন রফতানি আদেশ প্রায় বন্ধ ছিল। এপ্রিলজুড়ে বলতে গেলে পণ্য জাহাজীকরণ হয়নি। মে মাসে কিছুটা রফতানি আয় বেড়েছে।
সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের জুন থেকে মে মাস পর্যন্ত গত ১১ মাসে রফতানি কম হয়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ। এই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম হয়েছে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ১৫৫ কোটি ডলার। রফতানি হয়েছে তিন হাজার ৯৫ কোটি ডলারের পণ্য। গত বছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭৭৫ কোটি ডলার।
ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে তৈরি পোশাক রফতানি করে আয় করেছে মাত্র দুই হাজার ৫৭০ কোটি ডলার। যা গত বছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১৭৩ কোটি ডলার। পোশাক রফতনি করে আয় হয়েছে ২৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্য ছিল ৩৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের এই ১১ মাসে আয় হয়েছিল ৩১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। গত ১১ মাসে তৈরি পোশাকের রফতানি কমেছে ১৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা থেকে আয় কম হয়েছে ২৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।
টেরিটাওয়েলসহ পোশাক খাতের সমজাতীয় পণ্য মিলে মোট রফতানিতে পোশাক খাতের অবদান ৮৬ শতাংশ। এ খাতের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ মাসে মে মাসে ওভেন ও নিট খাতে পোশাক রফতানি কমেছে যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও ১৯ দশমিক ২২ শতাংশ। একই সঙ্গে কমেছে লক্ষ্যমাত্রাও।
অন্যান্য বড় পণ্যের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ২১ শতাংশের বেশি। লক্ষ্যমাত্রা থেকে আয় কম হয়েছে ২৬ শতাংশ। রফতানি হয়েছে মাত্র ৭৩ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের পণ্য। গত বছরের এই সময়ে এ পরিমাণ ছিল ৯৪ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। চিংড়িসহ হিমায়িত মাছের রপ্তানি কম হয়েছে ১০ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৪২ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য। বিভিন্ন ধরনের কৃষি পণ্যের রপ্তানি কম হয়েছে ৮ শতাংশের বেশি। ৭৮ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রফতানি হয়েছে গত ১১ মাসে। করোনায় ছোট-বড় সব পণ্যেরই রফতনি প্রবাহের একই চিত্র। ব্যতিক্রম শুধু ওষুধ, আসবাব ও পাট।
করোনাকালেও কাঁচা পাটসহ সব ধরনের পাটপণ্যের রফতনি বেড়েছে। পাট ও পাটপণ্যের রফতানি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫ কোটি ২৫ লাখ ডলার। এই সময়ে রফতানি আয় হয়েছে ৮১ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে এই সময়ে আয় হয়েছিল ৭৭ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ পাট ও পাটজাত পণ্যে ১১ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৮ দশমকি ৬৯ শতাংশ ও গত বছরের চেয়ে আয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
একইভাবে ওষুধের রফতানি বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ। যদিও লক্ষ্যমাত্রা থেকে রফতনি আয় ২১ শতাংশ কমেছে। মোট ১২ কোটি ডলারের ওষুধ রফতানি হয়েছে এ সময়।
রফতনিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সভাপতি ও সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মোর্শেদী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘রফতানি আয়ের এমন ধস নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কভিড-১৯ সাধারণ ছুটির ফলে এমনটা হয়েছে। তবে আশার কথা, আমাদের ক্রয়াদেশ আছে। ক্রেতাদের চাপও আছে। আগামী মাস থেকে এই আয় বাড়বে। এছাড়া জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ প্রচলিত বাজারগুলোতেও চাহিদা বাড়ছে’।