পশ্চাৎপদ ও ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের অধিনে থাকা পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরনো ঢাকার কেএন দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের অসাম্প্রদায়িক একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নতুন দল গঠন করে।php
প্রতিষ্ঠার সময়ই দলের অসাম্প্রদায়িক নামকরণের দাবি উঠলেও সমাজ বাস্তবতা ও তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলটি প্রতিষ্ঠার প্রায় চার বছর পর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নামে বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রমের ব্রত নিয়ে এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ।
প্রথম সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। প্রথম কমিটিতে তিনি কারাগারে থেকেই যুগ্ম সম্পাদক পদ পান। নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন।
১৯৬৬ সালের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলে রূপান্তরিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের শাসন-নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলন একপর্যায়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে দলটি অগ্রসর হয়। ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে বিপুল বিজয় ও স্বাধীনতার সংগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই গড়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ৭১ এ সংগঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয়। পাকিস্তানি শাসন আমলে এবং স্বাধীনতার পর ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী দীর্ঘ সময় দেশে একের পর এক আসা সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সব ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে ঐতিহ্যবাহী দলটি।
এই সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগকে অনেক প্রতিকুল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। অনেক চড়াই-উতরাই এবং ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। কখনও নেতৃত্ব শূন্যতা, কখনও দমন-পীড়ন, কখনও ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। এই শূন্যতা থেকেই দলের মধ্যে একাধিক ভাঙন ও গ্রুপিং ও বহু ধারার বিভক্তি দেখা দেয়। এরপর দলের চরম ক্রান্তিকালে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে শক্ত হাতে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। প্রায় চার দশক ধরে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। এই সময়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি চার বার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। তবে ৭১ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে, রাজপথে, আন্দোলন-সংগ্রামে। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করলেও তা বেশি দিন টেকেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পাঁচ বছর এবং বর্তমানে টানা সাড়ে ১২ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে।