শুরুর দিকে এটিএম বুথে শুধুমাত্র টাকা উত্তোলনের সুযোগ ছিল। বর্তমানে টাকা জমা করা, একাউন্ট ব্যালান্স দেখা, ফান্ড ট্রান্সফার, অ্যাপ ব্যবহার করে কার্ডবিহীন টাকা উত্তোলনসহ আধুনিক ও অবাক করা সব সেবা যুক্ত হয়েছে। এটিএম বুথ সেবা রয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংকেরই। গ্রাহকরা ২৪ ঘন্টা টাকা উত্তোলন করতে পারেন বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় ১২ হাজার এটিএম বুথ থেকে।
এনপিএসবির কল্যাণে এক ব্যাংকের গ্রাহক অন্য ব্যাংকের বুথ থেকে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে টাকা তুলতে পারছেন। কোন কোন ব্যাংকের বার্ষিক আয়ের বড় অংশই আসে এটিএম সেবা থেকে। আবার এটিএম কার্ডসেবাই কোনা কোন ব্যাংকের গ্রাহক আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এটিএম সেবা বিহীন ব্যাংকিং এখন কল্পনা করা যায় না।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এই মহাসড়কে উঠেও অনেক ব্যাংকের এটিএম সেবায় রয়ে গেছে বেশ কিছু দুর্বলতা যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ গ্রহাকদের। আর সুনাম হারাচ্ছে ব্যাংকগুলো। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া দুএকটি ঘটনার প্রেক্ষিতে এটিএম বুথ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।টিউশনি করে ব্যাংকে ২০ হাজার টাকা জমা করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া অর্ক (ছদ্ম নাম)। ঈদে মা-কে একটি ফ্রিজ উপহার দিয়ে চমকে দিতে চেয়েছিল। ঈদের আগে টাকা তুলতে যায় অন্য ব্যাংকের এটিএম বুথে। কার্ড প্রবেশ করিয়ে টাকার অংক কমান্ড দেয়ার পর এটিএম বুথে টাকা গণনা হয় এবং তার হিসাব ডেবিট হয়। কিন্তু এটিএম থেকে কোন টাকা বের হয় না। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর টাকা না পেয়ে কল সেন্টারে ফোন করে অভিযোগ করলে এক মাসের মধ্যে সেটেল করার আশ্বাস দেয়া হয়। একমাস পওে ব্যাংক থেকে জানানো হয় সে এটিএম থেকে টাকা গ্রহণ করেছে। নিজের অবস্থানে অটল থেকে সে ভিডিও ফুটেজের জন্য আবেদন করে।
অপর ব্যাংক ভিডিও ফুটেজ সরবরাহ করতে অস্বীকার করায় অপারগতা প্রকাশ কওে ব্যাংক। হাল ছেড়ে না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করে সে। কিছুদিন পর তাকে ডাকা হয়। সেখানে উক্ত ব্যাংকের সরবরাহ করা তিনটি ছবি দেখানো হয়। তিনটি ছবির দুটিতে তার ছবি এবং অপরটিতে ট্রে থেকে টাকা বের হবার ছবি। কিন্ত কে টাকা গ্রহণ করছে এমন কোন ছবি ছিল না। তাই সে ভিডিও ফুটেজ দাবি করে। কিন্তু উক্ত ব্যাংক টেকনিক্যাল সমস্যার কথা বলে ভিডিও ফুটেজ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তবুও গ্রাহকের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। ছেলেটি আর্থিক সংকটের কারণে আর কোর্টে যাওয়ার সাহস করেনি। অগত্যা বিশ হাজার টাকার আশা ছেড়ে দেয় সে।
দ্বিতীয় ঘটনা এ বছরের মার্চে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের ১১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের বিশেষ দল। তারা ডাচ বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথে টাকা লোড আনলোড করার দ্বায়িত্ব পালন করতো। উক্ত দলের সদস্যরা একটি ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর লোক। চক্রের সদস্যরা এটিএম বুথে টাকা লোড দেয়ার সময় টাকার গায়ে রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে জ্যাম করে রাখত। গ্রাহক কমান্ড দেয়ার পর একাউন্ট ডেবিট হয়ে যেত ঠিকই। কিন্তু জ্যামার দেয়ার কারণে মেশিন থেকে টাকা বের হতে পারতো না। গ্রাহক অভিযোগ করলে ব্যাংক তাদের টাকা দিয়ে দিত।
চক্রের সদস্যরা তাদের আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতদের অ্যাকাউন্টে ঐ টাকাগুলো জমা করে দিত। এভাবে ছয় মাসে ব্যাংকের সাড়ে তিন কোটি টাকা লোপাট করে চক্রটি। পরে তারা সুযোগ বুঝে গা ঢাকা দেয়। ঐ কোম্পানীতে চাকরির আগেও উক্ত চক্রের সদস্যরা অন্য একটি কোম্পানীতে একই কাজ করত। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাদের চাকরি চলে যায়। অন্য ব্যাংকের এটিএম থেকে টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে গ্রাহক হয়রানির খবর প্রায়ই শোনা যায়। তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির শিখরে অবস্থান করেও ব্যাংকগুলোর ভিডিও ফুটেজ দিতে না পারা গ্রহণযোগ্য নয়। এটিএম বুথ চালু করার সাথে সাথে সকল লেনদেনের ফুটেজ সংরক্ষণ করা ব্যাংকের দ্বায়িত্ব। ব্যাংকের দুর্বলতায় গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে দায় কে নেবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা দরকার।
এটিএম বুথ ব্যবস্থাপনায় তৃতীয় পক্ষকে নিয়োজিত করলেও টাকা লোড আনলোডের সময় ব্যাংকের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকা এবং তাদের কার্যক্রম নিয়মিত তদারকি করা দরকার। তৃতীয় পক্ষের সাথে এ ধরণের চুক্তি করার আগে ব্যাংককে টাকার নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। কোম্পানীগুলোর সততা ও দক্ষতা যাচাই করা ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
সম্প্রতি উত্তরায় একটি ব্যাংকের এটিএম বুথে একজন গ্রাহককে ছুরিকাঘাত করে হত্যার দৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ গ্রাহকসহ সকল শ্রেণীর মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। এটিএম বুথে প্রহরী নিয়োজিত থাকলেও তারা গভীর রাতে সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে সক্ষম নয়। গ্রাহকদের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে এটিএম বুথে টাকা উত্তোলন ও জমা দেয়ার সময়সীমা বেধে দেয়া এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের তদারকি আরো জোরদার করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। অনেক সময় এটিএম বুথে জাল টাকা ও ছেঁড়াফাটা অচল টাকা পাওয়ার খবর আসে। ছেঁড়া টাকা বের হলে গ্রাহকের করণীয় কি তা জানা না থাকায় অনেক গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হন।
তাই এটিএম বুথে সমস্যা হলে করণীয় বিষয়ে স্পষ্ট করে পোষ্টারে লিখে ব্যাংকের শাখা ও এটিএম বুথের দর্শনীয় স্থানে টাঙ্গিয়ে রাখা যেতে পারে। ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকেরও নিজের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে এটিএম থেকে টাকা উত্তোলনের স্থান ও সময় ব্যবস্থাপনায় সচেতন হওয়া জরুরী। এছাড়া ছেঁড়াফাটা ও জালনোট পেলে করনীয় কি তা জানাও গ্রাহকের কর্তব্য। প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করে দেয়।
প্রযুক্তিকে সঠিক ও সৎভাবে ব্যবহারের উপর নির্ভর করে তা গ্রাহকদের জন্য কতটা কল্যাণকর হবে। দক্ষ সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে বুথের পাহারা, বিদ্যুতের বিকল্প ব্যাকআপ নিশ্চিত করা, সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ, আন্তব্যাংক এটিএম ব্যবহারে দ্রুত গ্রাহকের অভিযোগ নিষ্পত্তি, উন্নত প্রযুক্তি, আধুনিক ও উন্নত মানের এটিএম মেশিন ব্যবহার করা না হলে গ্রাহকদের হয়রানির পরিমাণ বাড়তে থাকবে। গ্রাহক সেবার উন্নয়ন ও ব্যাংকগুলোর সুনাম ধরে রাখতে এটিএম বুথ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে এখনই।
রিয়াজ উদ্দিন: লেখক ও ব্যাংকার
ইমেইল : riyazenglish@gmail.com