একই সঙ্গে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলে তা কীভাবে বিশ্বজুড়ে সর্বসাধারণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়া যাবে সে ব্যাপারেও কিছু পরামর্শ বুধবার এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
২০০৬ সালে শান্তিতে বাংলাদেশের নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত ইউনূস সেন্টারের এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করেন ১৯ নোবেলজয়ী, ৩২ সাবেক সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রধানসহ ১১১ জন বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ব্যক্তি।
স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ডেসমন্ড টুটু, মিখাইল গর্বাচেভ, মালালা ইউসুফ জাই, বনো, রিচার্ড ব্র্যানসন, লেস ওয়ালেসা, জোডি উইলিয়ামস, মাহাথির মোহাম্মদ, লুলা, জর্জ ক্লুনি, শ্যারন স্টোন, ফরেস্ট উইটেকার, লিমা বুয়ী, মেরি রবিনসন, তাওয়াক্কুল কারমান, রতন টাটা, আজিম প্রেমজি, শাবানা আজমি, অ্যান ইদালগো, টমাস বাখ, আন্ড্রেয়া বোচেলিসহ আরও অনেকে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যেকোনও মহামারি পরিষ্কারভাবে একটি দেশের স্বাস্থ্যপরিচর্যা ব্যবস্থার শক্তি ও দুর্বলতাকে উন্মোচিত করে। একই সঙ্গে এ ব্যবস্থায় জনগণের প্রবেশাধিকারের বাধা ও অসমতাগুলো তুলে ধরে। আগত ভ্যাকসিনের প্রচারণার কার্যকারিতা নির্ভর করবে এর সার্বজনীনতার ওপর।
এতে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার, ফাউন্ডেশন, পরোপকারী ব্যক্তি ও সামাজিক ব্যবসাসমূহকে করোনার ভ্যাকসিনগুলো বিশ্বব্যাপী বিনামূল্যে উৎপাদন এবং বিতরণ কাজে সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে হবে। সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সংগঠনকে সব ধরনের বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্বল মানুষকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে সম্মিলিত দায়িত্ব পুনর্ব্যক্ত করার আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে।
জাতিসংঘ মহাসচিব, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক, ধর্মীয় নেতা, সামাজিক ও নৈতিক জগতের নেতৃবৃন্দ, গবেষণাগার ও ঔষধ কোম্পানিসমূহের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, আমরা সবাইকে একত্রিত হতে ও এটা নিশ্চিত করতে অনুরোধ করছি যেন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়; যাতে ভ্যাকসিনকে বিশ্বব্যাপী একটি সর্বসাধারণের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য ও ব্যবহার করা যায়।
ইউনূস সেন্টারের উদ্যোগে বিশ্ব নেতাদের দেয়া এই বিবৃতিতে ভ্যাকসিন কমন গুড ডট ওআরজি (VACCINECOMMONGOOD.ORG) ওয়েবসাইটে স্ব-স্ব প্রতিশ্রুতি নিয়ে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়।
বিবৃতিতে আর বলা হয়, আমরা সকল বিশ্ব নেতা, আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং সরকারসমূহের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে বৈশ্বিক সর্বসাধারণের একটি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হোক; যা সকল ধরনের প্যাটেন্ট অধিকারের আওতামুক্ত থাকবে।
‘স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমাদের অধিকার কেবল সবার একক ও সম্মিলিত দায়িত্বের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব। অগ্রাধিকার হিসেবে এ বিষয়ে আমাদের দায়িত্ব ও এই দায়িত্বকে প্রকৃত কর্মযজ্ঞে পরিণত করতে তাত্ত্বিক স্বীকৃতির প্রয়োজন। যেহেতু কোভিড-১৯ পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করে যাচ্ছে; তাই এই ভাইরাসের চিকিৎসা ও এর ভ্যাকসিন খুঁজে বের করতে বিশ্বে ব্যাপক গবেষণা কর্মকাণ্ড ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত হচ্ছে। এ বিষয়ে সকলেই একমত যে, এই মহামারিকে কার্যকরভাবে নির্মূল করতে হলে সকল ধনী ও দরিদ্র দেশের শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল এলাকার সব মানুষের জন্য এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ একান্ত প্রয়োজন।’
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার ও ফাউন্ডেশনসমূহ, বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক বিভিন্ন সংস্থা এবং স্থানীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর উচিত হবে এই ভ্যাকসিনকে কীভাবে বিনামূল্যে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়, তার বিস্তারিত কর্মপন্থা নির্ধারণ করা।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের গবেষণায় বিনিয়োগ থেকে ন্যায্য মুনাফা নির্ধারণে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, কোনও ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে পরিচালিত যেকোনও গবেষণা একটি দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে লেগে যেতে পারে প্রায় ১৮ মাস বা কিছু কম সময়; তাহলেও এটা হবে এ ধরনের আবিস্কারের ক্ষেত্রে একটি স্বল্পতম, রেকর্ড সময়।
‘গবেষণায় বিপুল পরিমাণ আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। এই ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে বেসরকারি খাতের অনেক গবেষণা সংস্থা এরই মধ্যে নিয়োজিত হয়েছে; যারা তাদের বিনিয়োগ থেকে মুনাফা প্রত্যাশা করছে। আবিস্কৃত ভ্যাকসিনকে গণমানুষের কাছে সহজলভ্য করার বিনিময়ে এই বিনিয়োগ থেকে ন্যায্য মুনাফা কী হবে তা নির্ধারণ করার জন্য আমাদেরকে একটি সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য বেসরকারি খাত, বিজ্ঞানীমহল ও সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যুকৃত বিভিন্ন তথ্য সময়োপযোগী, যথাযথ, দ্ব্যর্থহীন, সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। গবেষণার ফলাফলগুলোকে প্রকাশ্য হতে হবে; যেন কঠোর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে থেকে উপযুক্ত যেকোনো ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী সংস্থা এই তথ্যগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারে।’
বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য একটি বৈশ্বিক কর্ম-পরিকল্পনা তৈরির আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, আমরা সংস্থাটিকে ভ্যাকসিনবিষয়ক গবেষণা মনিটরিং এবং একটি পূর্ব-ঘোষিত সময় কাঠামোর মধ্যে পৃথিবীর সকল দেশ ও মানুষের কাছে এই ভ্যাকসিন যাতে একইভাবে পৌঁছানো যায় তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক কমিটি গঠনের আহ্বান জানাচ্ছি।