পুঁজিবাজারে টানা বড় দর পতনের প্রেক্ষিতে ওই বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এতে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) নির্বাহী কমিটি, শীর্ষ ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংকার এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বিএসইসির কমিশনার ড. স্বপন কুমার বালা এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান এবং পরিচালক শেখ মাহবুবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, বৈঠকে বিএসইসির পক্ষ থেকে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতির কারণ সম্পর্কে স্টেকহোল্ডারদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ জানতে চাওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে স্টেকহোল্ডাররা বাজারের এই পতন ধারার জন্য অন্যান্য কারণের পাশাপাশি বিএসইসি সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো বিষয় তুলে ধরেন।
স্টেকহোল্ডারদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিএসইসি সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইপিওর অনুমোদন দিয়েছে, তার বেশির ভাগই অত্যন্ত দুর্বল মৌলভিত্তির। কিন্তু তা সত্ত্বেও তালিকাভুক্তির পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত এসব শেয়ার ৬ গুণ বা ৭ গুণ দামে লেনদেন হয়েছে। আর এটি হয়েছে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কারসাজির মাধ্যমে। তারা শেয়ারের দাম বাড়িয়ে প্লেসমেন্টে পাওয়া তাদের সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নিয়েছেন। তাদের শেয়ার বিক্রি হওয়ার পর থেকে কোম্পানির আয় এবং শেয়ারের দাম কেবলই কমেছে। কিন্তু এই কারসাজির বিষয়ে বিএসইসি কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
স্টেকহোল্ডাররা অভিযোগ করেন, শুধু নতুন আইপিওর শেয়ার নয়, পুরনো জাঙ্ক শেয়ার নিয়েও বাজারে নিয়মিত কারসাজি হচ্ছে। কারখানা বন্ধ, উৎপাদন নেই, বিক্রি নেই অথচ ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার বাজারে ৬শ/৭শ টাকায় কেনা বেচা হয়। কোনো কোনোটি এরচেয়েও বেশী দামে কেনাবেচা হয়েছে। কারসাজি ছাড়া এটা সম্ভব নয়। কিন্তু কারসাজি বন্ধ ও দোষীদের শাস্তির ব্যাপারে বিএসইসি কোনো উদ্যেগ নেয়নি। অথচ বিএসইসিতে স্টেট অব দ্যা আর্ট সার্ভিলেন্স সফটওয়্যার রয়েছে। তারা প্রশ্ন করেন, কারসাজিই যদি চিহ্নিত করা না যায়, তাহলে এত দামি সফটওয়্যার রেখে লাভ কী?
তারা আরও অভিযোগ করেন, দুয়েকটি ক্ষেত্রে বিএসইসি ব্যবস্থা নিলেও সেটি হয়ে থাকে ঘটনা ঘটে যাওয়ার ৫/৭ বছর পর। এতে বাজারে কোনো প্রভাব পড়ে না।
ডিবিএর অন্য একজন কর্মকর্তা আইসিবির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলেন। তিনি বলেন, এক সময় আইসিবি বাজার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতো। এখন এটি শেয়ার ডাম্পিং এর ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অসাধু উদ্যোক্তা ও কারসাজিকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে আইসিবি ব্লকে উচ্চ মূল্যে পঁচা শেয়ার কিনে নেয়, কেয়া কসমেটিকস, ইফাদ অটো, ড্রাগন সোয়েটারসহ এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
ব্যাংকভিত্তিক একটি ব্রোকারহাউজের কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানি আইনের কিছু ধারার কারণে বাজারে শেয়ারের চাহিদা বাড়ছে না। পতনমুখী বাজারে অনেকেই তুলনামূলক কম দামে শেয়ার কিনে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের সদস্য হতে ইচ্ছুক। কিন্তু কোম্পানির অন্য পরিচালকরা কো-অপ্ট করতে আগ্রহী নয় বলে তারা পর্ষদে যেতে পারেন না। পর্ষদে যাওয়ার সহজ সুযোগ থাকলে দু’ভাবে বাজার উপকৃত হতো। প্রথমত এর ফলে বাজারে শেয়ারের চাহিদা বাড়ত। অন্যদিকে তাদের অন্তর্ভুক্তির ফলে পর্ষদে আরও স্বচ্ছতা এবং গতি বাড়ত।
বৈঠকে একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার বাজারের এমন পরিস্থিতিতে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওতে আসতে ইচ্ছুক কোম্পানিগুলোকে দ্রুততম সময়ে আসার সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এই সময়ে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কোম্পানি বাজারে এলে বিনিয়োগকারীরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন, বাজার বিডিং এ অন্য সময়ের তুলনায় শেয়ারের দাম উঠার সম্ভাবনা কম।
একজন ব্রোকার অভিযোগ করেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মুনাফায় বড় ধরনের পরিবর্তন হলে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা কোনো কোম্পানিই মানছে না। বড় বিচ্যুতি বা পরিবর্তন হার নির্ধারণ করে না দেওয়ায় ওই সুযোগটি নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। অন্যদিকে কোম্পানিগুলো আর্নিংস কলও করছে না।
ব্যাংক ঋণের সুদ হারে নয়-ছয় প্রস্তাব সম্পর্কে একজন ব্রোকার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এটি বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকগুলো চরম সঙ্কটে পড়বে। অনেক ব্যাংক ঋণ বিতরণ কমিয়ে দিতে পারে। ব্যাপকভাবে কমে যাবে এসএমই ঋণ বিতরণের পরিমাণ। সামগ্রিক অর্থনীতিতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তা থেকে পুঁজিবাজারও বাদ যাবে না।
বিএসইসির পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়, তারা এসব সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করে দেখবেন।