সাধারণ মানুষের ঈদের আনন্দকে অর্থবহ করে তুলতে ব্যাংকগুলো নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ঈদুল আযহায় পশু কেনাকাটায় প্রচুর অর্থ লেনদেন হয়। নগদ টাকা বহন করার অনেক ঝুঁকি রয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী তাদের সর্বস্ব খুইয়েছেন ছিনতাইকারী, পকেটমার ও ডাকাতের হাতে। নগদ টাকার সাথে নিজের জীবনও হারিয়েছেন অনেক গরু ব্যবসায়ী।
গ্রাহকরাও খুইয়েছেন তাদের কুরবানীর পশু কেনার টাকা। সাধারণ মানুষের তথা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জীবন সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে ২০২২ সালে ঢাকা শহরের ৬ টি গরুর হাটে ডিজিটাল লেনদেন চালু করা হয়।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ স্মার্ট হাট’এই শ্লোগান ধারণ করে যাত্রা শুরু করে এ কার্যক্রম। এসব স্মার্ট হাটে ব্যাংকগুলোর ডিজিটাল বুথ থাকবে যেখানে টাকা তোলার ও জমা করার জন্য থাকবে এটিএম ও সিআরএম। এসব বুথে আরো থাকছে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা। খামারিদের কাছে থাকছে পস মেশিন যার মাধ্যমে কার্ড ব্যবহার করে টাকা দেয়া যায়। আরো থাকবে বাংলা কিউ আর যা স্ক্যান করে স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে কেনাকাটার বিল দেয়া যায়। এসব ডিজিটাল সেবা ব্যবহার করে বিক্রেতার হিসাবে টাকা জমা করার ব্যবস্থা রয়েছে। হাসিলও পরিশোধ করা যাবে বাংলা কিউআর-এ।
প্রথম বছরেই সফলতা পায় স্মার্ট হাট। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের ব্যাপক আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। ২০২২ সালে পরীক্ষামূলক এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা ক্যাশলেস লেনদেন হয়। ব্যাংক হিসাব না থাকায় অনেকে শুরুতে লেনদেন করতে পারেননি। এ বছর দেশের প্রায় ১০ হাজারের বেশি খামারির ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে।
এবছর ঢাকার ৮টি ও চট্টগ্রামের ২টি সহ ১০টি স্মার্ট হাটে এবছর ডিজিটাল মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা লেনদেনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি খামারি যদি ব্যাংক হিসাব খোলেন তাহলে স্মার্ট লেনদেন অনেকটা সহজ হবে। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংক দেশের গুরুত্বপূর্ন পশুর হাটগুলোতে ব্যবসারীদের সাথে মত বিনিময় সভা আয়োজন করে। এসব সভায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্মার্ট ব্যাংকিংয়ের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। এছাড়া ব্যাংকগুলো খামারিদের হিসাব খোলা সহজ করার ব্যবস্থা নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা স্মার্ট হাটে তাৎক্ষণিক ব্যাংক হিসাব খুলে টাকা জমা দিতে পারবেন।
এর মাধ্যমে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এসব বুথে স্মার্ট লেনদেনের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে খামারিদের ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ প্রদান করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো অনেক আগে থেকেই পশুর হাটগুলোতে জাল টাকা সনাক্তকরন মেশিনের মাধ্যমে টাকা সনাক্ত করতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় ব্যবসায়ীদের টাকা জমা দেয়ার সুবিধার্থে গরুর হাট সংলগ্ন ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ শাখাসমূহ খোলা রাখা হয়।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি ব্যাংকিং কার্যক্রমকেও স্মার্ট করার কোন বিকল্প নেই। ইতোমধ্যেই ব্যাংকগুলো ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অ্যাপ ভিত্তিক ব্যাংকিং, কার্ড ভিত্তিক ব্যাংকিং সহ চালু করেছে হরেক রকম স্মার্ট সেবা। টাকা জমা করার জন্য এখন আর ব্যাংকের কাউন্টারে ভিড় করার দরকার হয়না। মেশিনের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা টাকা জমা করা যায় ব্যাংকের হিসাবে।
কেনাকাটার দাম পরিশোধ করতেও নগদ টাকা বহন করার প্রয়োজন নেই। কার্ডের মাধ্যমে অথবা যেকোন ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বিক্রেতার ব্যাংক হিসেবে টাকা দেয়া যায় অনায়াসে। ব্যংকগুলো প্রযুক্তিগত সেবায় যথেষ্ট স্মার্ট হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কেবল ব্যাংকগুলো স্মার্ট হলেই হবে না, গ্রাহকদেরও স্মার্ট করা প্রয়োজন।
এজন্য পর্যাপ্ত প্রচার প্রচারণারও প্রয়োজন রয়েছে। স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটার তথা সকল ডিজিটাল মাধ্যমই এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথা প্রতিটি মানুষের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। ব্যাংকের শাখা উপশাখা এবং এজেন্ট আউটলেটও এখন সবার দোরগোড়ায়। ব্যাংকারদের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে স্মার্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমকে আরো বেগবান করতে।
কুরবানীর হাটের গরু কেনা কাটাতেই শুধু ব্যাংকের ব্যস্ততা শেষ নয়। কুরবানীর পশুর চামড়া ব্যবস্থাপনাও আমাদের সামগ্রিক আর্থিক কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চামড়া ব্যবসায়ীদেরকেও প্রতি বছর বিনিয়োগ দিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো। এবছরও ইসলামী ব্যাংকসহ ১০টি ব্যাংক চামড়া ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ প্রদান করতে ২৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। ঈদের সময় বাজারে নিত্য পণ্যের পাশাপাশি চিনি, সেমাই ও মশলাসহ বিভিন্ন দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যায়।
বাজারে পর্যাপ্ত নিত্যপন্য সরবরাহ করতে দেশে উৎপাদনের পাশাপাশি অনেক পণ্য আমদানী করা হয়। এসব পন্য উৎপাদন, আমদানী ও সরবরাহেও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ দেয় ব্যাংকগুলো। এছাড়া তৈরি পোশাকের চাহিদা পূরণে গার্মেন্টস এবং ফ্যাশন হাউসগুলোকে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ দেয় ব্যাংক যা সাধারণ মানুষের সামনে তাদের পছন্দের পন্য হাজির করে তাদের ঈদের খুশির উপকরণ যোগায়।
এছাড়া ঈদুল ফিতরে ব্যবসায়ীদের টাকা পয়সা জমা করার এবং গার্মেন্টস সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন ভাতা প্রদানের জন্য ছুটির সময়েও খোলা রাখা হয় ব্যাংকের শাখা। ঈদের সময়ে প্রবাসীরা অন্য সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন।
তাদের পাঠানো টাকা স্বজনদের কাছে পৌঁছাতেও অতিরিক্ত চাপ নিয়ে হাসি মুখে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকাররা। নতুন টাকা ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ। ছেলে-বুড়ো সবাই নতুন টাকা পছন্দ করে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার পূর্ব মহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে নতুন টাকা অবমুক্ত করে। ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখা থেকে এসব নোট সরবরাহ করা হয়।
নতুন টাকা সংগ্রহের জন্য এসব ব্যাংকের শাখায় গ্রহকদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। ঈদের ছুটিতেও যেন গ্রাহকরা পর্যাপ্ত নগদ টাকা পেতে পারেন সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে। এটিএম বুথগুলোতে রাখা হয় পর্যাপ্ত নগদ টাকা। কোন বুথে টাকা শেষ হয়ে গেলে দ্রুত সেটা পূরণ করার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও অন্যান্য ডিজিটাল সেবা ব্যবহার করে টাকা লেনদেন ও কেনাকাটার সুযোগ তো থাকছেই।
সামগ্রিকভাবে ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে তুলতে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের জন্য নানাবিধ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষই যেন ব্যাংকগুলোর এই স্মার্ট সেবা গ্রহণ করে জীবন সহজ করতে পারেন সেজন্য স্মার্ট ব্যাংকিং বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।
লেখক: রিয়াজ উদ্দিন, ব্যাংকার