বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, এক বছর আগে এই দেশ বিদেশি মুদ্রার প্রচণ্ড সংকটে হিমশিম খাচ্ছিল। জ্বালানি কেনার মতো টাকা ছিল না, রাস্তাঘাট ছিল জনশূন্য, এমনকি গণপরিবহনব্যবস্থাও থমকে গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কা আবারও মহামারি যুগের ব্যবস্থায় ফেরত যায়। যেমন দেশটির স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম তখন অনলাইনে হতো এবং মানুষ ঘর থেকে কাজ করতেন। কিন্তু বিদ্যুৎ-ঘাটতির কারণে অনেক সময় সেটাও সম্ভব হতো না, দিনের ১২-১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না তখন।
খাদ্য-ওষুধ থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি ছিল বাজারে। এতে সংকট আরও প্রকট হয়। তীব্র গরমে মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে এসব সংগ্রহ করতে হতো। সে কারণে অন্তত ১৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বয়স্ক মানুষ।
তবে আজ এক বছর পর খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণের ঘাটতি নেই বাজারে; অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, কারখানা—সবই এখন খোলা। রাস্তায় গণপরিবহনও চলছে। মানুষ রেস্তোরাঁয় যাচ্ছে, বিশেষ করে উচ্চবিত্তদের জন্য তৈরি রেস্তোরাঁগুলোতে মানুষের ভিড় লেগে আছে।
দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার মূল উৎস পর্যটন খাতও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। এ খাতে গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি রাজস্ব আয় ইতিমধ্যেই হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার শীর্ষ স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সি জেটউইংস সিম্ফনির প্রধান নির্বাহী হিরন কুরে বলেন, ‘আমাদের খাত যেন জাদুর মতো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, অথচ গত বছর আমরা জানতাম না, দেশ কোথায় যাবে।’
তবে এসব ভালো খবর সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এখনো ঝুঁকির জায়গা আছে।
দেশটির ঘাড়ে দেশি ও বিদেশি মিলে মোট ৮০ বিলিয়ন বা ৮ হাজার কোটি ডলারের বেশি ঋণ আছে। গত বছর দেশটির সংকট এত গভীর ছিল যে তারা ইতিহাসে প্রথম বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে খেলাপি হয়।
তবে শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আইএমএফের ঋণের জন্য অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়। তারই অংশ হিসেবে আইএমএফ এখন ঋণ পরিশোধের শর্ত পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে, বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ উভয় ঋণের ক্ষেত্রেই।
তবে মূল নজরটা এখন ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ পুনর্গঠনের দিকে। এর মধ্যে আছে চীনের কাছ থেকে নেওয়া ৭০০ কোটি ডলারের ঋণ।
তবে দেশীয় ঋণ পুনর্গঠনের প্রভাব জনগণের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশটির মোট ঋণের অর্ধেকের মতোই দেশি ঋণ। শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভা সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ ঋণ পুনর্গঠন প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। কিন্তু এতে শ্রমিকদের পেনশন হ্রাসের বিষয় থাকায় তা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। কলম্বোয় সেই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।
আর এতেই বোঝা যাচ্ছে, আপাতদৃষ্টে শ্রীলঙ্কার জনজীবন স্বাভাবিক মনে হলেও বাস্তবতা হলো, মানুষ এখনো কষ্ট করছে।
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ আছে, তবে তা অনেকেরই সাধ্যের বাইরে। জিনিসপত্রের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্ধেকের বেশি পরিবার আয়ের প্রায় অর্ধেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে ব্যয় করে। খাদ্য, পোশাক ও বাড়ির দাম বাড়ছেই।
সেই সঙ্গে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো যুক্ত হয়েছে করের বোঝা: আয়কর ৩৬ শতাংশে উন্নীত করার পাশাপাশি খাদ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সব ধরনের পরিষেবা থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বিদ্যুতে। ভর্তুকি প্রত্যাহারের কারণে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৬৫ শতাংশ।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ভেরাইট রিসার্চের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ মারাথি নাইট বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
এখানেই শেষ নয়, বিশ্বব্যাংক মনে করছে যে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে।
এক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, আগামী কয়েক বছর শ্রীলঙ্কার দারিদ্র্য ২৫ শতাংশের ওপরে থাকবে। তারা বাজেট সহায়তা হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে ৭০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে, যার মধ্যে দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষের জন্য ২০ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ব্যয় কমাতে শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইনস, শ্রীলঙ্কা ইনস্যুরেন্স করপোরেশন ও শ্রীলঙ্কা টেলিকমের মতো রাষ্ট্রীয় সংস্থা বেসরকারিকরণের প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। কিন্তু মানুষ ধারণা করছে, এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের চাকরি যাবে। প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমেছে এবং সরকার যথারীতি পুলিশ দিয়ে সেই আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সরকারের উচিত হবে, বলপ্রয়োগ না করে জনগণের কাছে স্বচ্ছ অবস্থান নেওয়া।