ওই হামলায় আওয়ামী লীগের আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন, আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী। সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও বিস্ফোরণের শব্দে শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।এরপর এই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তে শুরু হয় নানান নাটক। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার নানা চেষ্টা করে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রাণ ফিরে পায় মামলাটি। বেশ কয়েকবার বাঁক বদলের পর বেরিয়ে আসতে থাকে আসল রহস্য।
সেদিন যা ঘটেছিল
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ২১ আগস্ট সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ। যে ট্রাকটিকে (ঢাকা মেট্রো-ট-১১-৩০৯৮) উন্মুক্ত মঞ্চ করা হয়েছিল, সেটিকে ঘিরে শনিবার বিকেল ৪টা থেকেই দলীয় ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভিড় করছিলেন। পুরো এলাকা জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে মুখরিত ছিল। বিকেল ৫টায় সমাবেশ স্থলে আসেন শেখ হাসিনা। বিকেল ৫টা ২ মিনিটে মঞ্চে উঠে বক্তব্য শুরু করেন। টানা ২০ মিনিট বক্তব্য দিলেন। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে নিজেই জয় বাংলা..জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে মাইক নামাচ্ছিলেন।ঠিক তখনই মঞ্চের দক্ষিণ পাশ থেকে ছোড়া একটি গ্রেনেড একেবারে মঞ্চের কাছে এসে পড়ে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডটি। মঞ্চ টার্গেট করে দক্ষিণ পাশ থেকে একে পর এক গ্রেনেড হামলা হতে থাকে। মাত্র দেড় মিনিটে ব্যবধানে ১৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হয় সমাবেশ স্থলে।আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে রক্ষায় তৈরি করে ফেলেন মানব দেয়াল। মঞ্চে এ অবস্থায় থাকেন কিছুক্ষণ। পরিস্থিতি বুঝে শেখ হাসিনাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে তার বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। ওই গাড়ি লক্ষ্য করেও গুলি ছোঁড়ে হামলাকারীরা।
২১ আগস্টের ওই ঘটনার দিন নেতা-কর্মীদের নিয়ে রাস্তায় বসেছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমান। গ্রেনেডে আঘাতে তাৎক্ষণিক গুরুতর আহত হন তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু হয় তার। তিনিসহ মোট ২৪ জন হামলার ঘটনায় নিহত হন। আহত হন দল ও সংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মী-সমর্থক।
ওইদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। রাস্তায় পড়ে ছিল অগণিত রক্তসহ জুতা, স্যান্ডেল। অবিস্ফোরিত গ্রেনেডও পড়ে ছিল কয়েকটি। এ হামলায় মানব দেয়ালের কারণে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার দুই কান ও চোখ। অপূরণীয় ক্ষতি হয় তার শ্রবণশক্তির।
সোমবার (২১ আগস্ট) সেই রক্তস্নাত ভয়াবহ বিভীষিকাময়, বর্বরোচিত ও বীভৎস হত্যাযজ্ঞের উনিশতম বার্ষিকী।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথম দফায় হামলার পর স্টেডিয়ামের দিক হয়ে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত শেখ হাসিনাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। দলীয় সভাপতি যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন, তখনও একই দিক থেকে কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে গ্রেনেড ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হতে থাকে। একইসঙ্গে চলছিল তার গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি। এসব গুলি ও গ্রেনেড ঠিক কোথা থেকে ছোড়া হচ্ছিল, তা বোঝা না গেলেও বেশ পরিকল্পিতভাবে যে হামলা হয়েছে, তা পরে বোঝা যায়।
ধানমন্ডির সুধা সদনে শেখ হাসিনাকে বহনকারী গাড়িটি পৌঁছানোর পর সেটির সামনে-পেছনে গ্রেনেড ও গুলির আঘাতের অসংখ্য চিহ্ন দেখা গেছে।
ঘটনাস্থলের বর্ণনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চারদিকে ছোপ ছোপ রক্ত আর মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় অ্যাভিনিউ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশাভ্যানে করে আহতদের প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অনেককে দেখা যায় রাস্তায় পড়ে আকুতির চোখে সাহায্যের আবেদন করছেন, তাদের মুখে কথা নেই। দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ আহতদের সহায়তা ও হাসপাতালে নেওয়ার কাজে এগিয়ে এলেও এ সময় পুলিশ ছিল নীরব।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, বিস্ফোরণের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগ কর্মীরা সেদিন ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এদিকে ঘটনার পর সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অনেক স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে বিক্ষুব্ধ কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে থাকে।
এ ঘটনায় মামলা করে আওয়ামী লীগ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক জিয়া, চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৫২ জনকে আসামি করা হয়।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন।
ভয়ংকর সেই গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে মোট ১১ আসামিকে।
বাকি তিনজনের মধ্যে হুজি নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি কার্যকর হয় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায়। আরেক আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। তাই তাদের এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ অনেকেই বর্তমানে কারাগারে আছেন। রায় ঘোষণার সময় তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক দেখানো হয়েছিল। পরবর্তীতে পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাইদ হাসান এবং ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ইকবাল নামে এক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এর ফলে সর্বশেষ পলাতক রয়েছেন ১৫ জন, এরমধ্যে বর্তমানে অন্তত ৮ জন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।