দেশটিতে ঘটে যাওয়া 'প্রকৃত ঘটনাগুলোর' ওপর নির্ভর করে অ্যাপ-ভিত্তিক একটি মোবাইল গেম তৈরি করেন তিনি। যা দেশটির জনতার কাছে পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা; সেনা সরকারও ক্ষুদ্ধ, কারণ এর মাধ্যমে পাওয়া অর্থ দিয়ে জান্তা-বিরোধী প্রতিরোধের তহবিল জোগানো হচ্ছে।
গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকে সমর্থন দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার হওয়া বন্ধু দম্পতির প্রসঙ্গে কো তুত বলেন, 'তারা জীবনে কখনো কোনো অপরাধ করেননি।'
কো তুত জানেন না গ্রেপ্তারের পর তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তবে বিবিসি সম্প্রতি নিশ্চিত হয়েছে যে, তার বন্ধুপত্নীকে গ্রেপ্তারের একদিন পরই মুক্তি দেওয়া হয়। তবে তার বন্ধু প্রায় দেড় বছর ধরে বন্দি আছেন।
এরপর আরেকটি ঘটনা শোনেন কো তুত, যা তার ক্ষোভকে উস্কে দেয়। একটা কিছু করতে বদ্ধপরিকর করে। তিনি জানতে পারেন, গণতন্ত্রপন্থী এক অধিকারকর্মীকে খুঁজে না পাওয়ায়, সেনারা তার স্ত্রী ও শিশু কন্যাকে গ্রেপ্তার করেছে।
কো তুত বলেন, 'একটি শিশু নোংরা, নিপীড়নমূলক একটি কারাগারে বেড়ে উঠছে – একবার ভেবে দেখুন। কি হচ্ছে, সে সম্পর্কে শিশুটির কোনো ধারণাই নেই। একথা ভেবেই আমার রক্ত গরম হয়ে ওঠে।'
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতেই আইটি পেশাজীবী কো তুত 'নির্দয় ও বিপজ্জনক' জান্তা সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর আন্দোলনে যোগ দেন, এবং মোবাইল গেম তৈরির কাজ শুরু করেন।
একটি ইনক্রিপ্টেড অ্যাপের সাহায্যে এসব বিবরণ বিবিসিকে জানান তিনি। এই অ্যাপ ব্যবহার করায় তার বর্তমান অবস্থান গোপন থাকে। নিরাপত্তার স্বার্থে কো তুত ছদ্মনামে তার কাহিনি প্রকাশ করেছে বিবিসি।
অভ্যুত্থানের পর জান্তা সরকার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে কঠোরভাবে দমন করতে থাকলে, মানুষ প্রতিবাদের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামকেই বেছে নেয়। ফলে এক পর্যায়ে গৃহযুদ্ধে নিপতীত হয় মিয়ানমার।
রাজনৈতিক বন্দিদের সহায়তার জন্য গঠিত – অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স মনিটরিং গ্রুপের মতে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এপর্যন্ত ৪ হাজারের বেশি সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী। তবে জাতিসংঘের মতে, নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে।
যুদ্ধে কতজন সেনা নিহত হয়েছে, তার অনুমান করা মুশকিল। কারণ, বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হতাহতের ঘটনা স্বীকার করলেও, মোট নিহতের সংখ্যা কখনো প্রকাশ করেনি। তবে নির্বাসনে গঠিত মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারের দাবি, প্রতিরোধ যোদ্ধারা অন্তত ২০ হাজার সেনাকে হত্যা করেছে। যদিও এই সংখ্যাটি সম্পর্কে বিবিসি নিশ্চিত হতে পারেনি।
কো তুতের লক্ষ্য হলো পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) নামে পরিচিত জান্তা-বিরোধী প্রতিরোধ বাহিনীর অস্ত্র ও মানবিক ত্রাণের জন্য তহবিল সংগ্রহ। একইসঙ্গে দেশটির পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে ব্যাপক সহায়তা নিয়ে কিয়েভের পাশে দাঁড়িয়েছে – তার তুলনায় মিয়ানমারের সংগ্রাম উপেক্ষিত হয়েছে বলে মনে করেন কো তুত। তিনি বলেন, 'আমরা খুবই কম আন্তর্জাতিক সহায়তা পেয়েছি, বিশ্বপর্যায়ে মিয়ানমারকে নিয়ে সচেতনতাও কম।'
এটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়, তবে গেমের মধ্যে আসা বিজ্ঞাপনগুলো থেকে অর্থ আয় হয়। কো তুতের অনুমান, গেমটি যাত্রা শুরুর পর থেকে এপর্যন্ত ৫ লাখ ৮ হাজার ডলার আয় করেছে।
তার হিসাবমতে, প্রতি মাসে এখন এই গেমের মাধ্যমে আয় হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার ডলার, প্রতি মাসে এই অঙ্কটা বাড়ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
গেম খেলার সময় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত একজন পিডিএফ যোদ্ধা হিসেবে খেলেন গেমাররা। মিয়ানমারে পিডিএফ বাহিনী যেরকম অভিযান চালায়, তারই আদলে গেমে বিভিন্ন মিশন রাখা হয়েছে। খেলোয়াড়দের পর্যায়ক্রমে এসব মিশন খেলতে হয়।
জান্তা-বিরোধী লড়াইয়ে অংশ নেওয়া সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের বাস্তব চরিত্রগুলোর অনুকরণেই গেম ক্যারেক্টারগুলো তৈরি করা হয়েছে। এদের মধ্যে চিকিৎসক, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ও এলজিবিটি-সহ নানান ক্যারেক্টার রয়েছে।
কো তুত বলেন, তাদের প্রতিনিধিত্ব রাখাকে জরুরি বলে মনে করেছি, কারণ তারা 'সত্যিকারের মানুষ যারা একটি প্রকৃত যুদ্ধে লড়ছেন।'
তবে সংবেদনশীল কন্টেন্টের জন্য গুগল ও অ্যাপলের কোম্পানি নীতির কারণে গেমটি নিয়ে বিভিন্ন সময় সমস্যা হয়েছে বলে জানান কো তুত।
পরে গুগল প্লে'তে গেমটির নাম বদলে রাখা হয়েছে 'ওয়ার অব হিরোস- দ্য পিডিএফ গেম'। গুগল জানায়, 'সংবেদনশীল কোনো ঘটনাকে উপজীব্য করে বা তাকে তুচ্ছ করে' এমন কোনো অ্যাপ তারা প্রকাশের অনুমতি দেয় না। তবে ওই ঘটনার বিষয়ে 'ব্যবহারকারীদের সতর্ক করতে বা তাদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্য আছে' এমন কন্টেন্ট তারা প্রকাশের অনুমতি দেয়।
অ্যাপল অ্যাপ স্টোর গেমটি সরিয়ে নেওয়ার আগে এর নাম বদলে রাখা হয়েছিল 'ওয়ার অব হিরোস'। অ্যাপলের সিদ্ধান্ত তার জন্য বড় ধাক্কা ছিল বলে জানান কো তুত।
এবিষয়ে অ্যাপল জানিয়েছে, গেমটি তাদের বিধিমালা ভঙ্গ করেছে। কারণ গেমে শত্রুপক্ষ কোনো দেশের 'সত্যিকারের সরকার, সংস্থা বা অন্য কোনো সত্ত্বাকে – একমাত্র লক্ষ্যবস্তু করতে পারে না'। একইসঙ্গে সহিংস সংঘাতের বিষয়ে তাদের নীতিমালাও ভঙ্গ করেছে গেমটি।
এই পদক্ষেপের পর কো তুত ভুল স্বীকার করে গেমটির কিছু সংশোধন করেন। পরিবর্তন আনেন গেমের প্রথমদিকের আর্টওয়ার্কে, কিছু সামরিক মিশনও গেম থেকে বাদ দেন।
এরপর অ্যাপল আবার গেমটি তাদের অ্যাপ স্টোরে যুক্ত করেছে। কো তুত বলেন, 'এটা নিঃসন্দেহে একটা সুসংবাদ, এখন আমরা আরো বেশি আয় করতে পারব বলে আশা করছি।'
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চার করেছে এই গেম। গত এপ্রিলে রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমে নোটিশ জারি করে জনগণকে হুঁশিয়ার দিয়ে তারা জানায়, কেউ 'পিডিএফ গেম খেললে' তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নোটিশে বলা হয়, নির্বাসিত জাতীয় ঐক্যের সরকারের মতো 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো' পিডিএফের জন্য তহবিল জোগাড় করতে, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনমনে 'অনাস্থার বীজ বুনে দিতে' এবং এভাবে 'তাদের সরকার-বিরোধী বিপ্লবী চেতনা' ছড়িয়ে দিতে এই গেম তৈরি করেছে।
জান্তা-বিরোধী লড়াইয়ের জন্য গেম থেকে পাওয়া অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। ছবি: বিবিসি
সামরিক বাহিনীর হুমকির মুখেও অবিচল কো তুত। তিনি বলেন, 'ওরা কী বলে আমি তার পরোয়া করি না।'
সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার এই অনলাইন প্রচেষ্টা সম্পর্কে তার বক্তব্য, 'ইতোমধ্যেই তারা বেশ কয়েকবার এই গেমটি বন্ধের চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমাদের দমানো যাবে না, ডিজিটাল আঘাত থামানোর কোনো উপায় তাদের নেই।'
কো তুত জানান, গেমটি এপর্যন্ত ১০ লাখ বার ডাউনলোড করা হয়েছে। গুগল জানিয়েছে, তাদের প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করা হয়েছে পাঁচ লাখ বার। তবে ডাউনলোড সংখ্যা নিয়ে কোনো তথ্য দেয়নি অ্যাপল।
কো তুত মনে করেন, তার যা ধারণা তার চেয়েও অনেক বেশি অর্থ এই গেমের মাধ্যমে আয় হয়েছে। কারণ শুরুতে তার ডেভেলপার টিম ছিল খুবই ছোট। তাদের নিয়ে দীর্ঘদিন গেমটি ডেভেলপ করার পর কিছু কিছু পরিমাণে টাকা পেতে শুরু করেন।
এসব অর্থ সরাসরি দেওয়া হয়েছে পিডিএফের স্থানীয় ইউনিটগুলোকে, যা দিয়ে তারা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য খাদ্য ও অস্ত্র কিনেছে, বা মানবিক ত্রাণ দিতে ব্যবহার করেছে। সংঘাতে অভিভাবক হারানো শিশু এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহত যোদ্ধাদের জন্যেও এই তহবিল থেকে ত্রাণ দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
তার ভাষ্য, 'আমরা শুধু প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর কাছে তহবিল পাঠাই, কিন্তু কীভাবে তারা অর্থের ব্যবহার করবে, তা বলে দেই না।'
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে গড়ে ওঠে পিডিএফ। কিন্তু, মিয়ানমারের জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে। এসব গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বেশি সক্রিয়। তাদের সাথেই হাত মেলায় পিডিএফ।
একযোগে তারা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বলিষ্ঠ শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের কাছে দেশের বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
তবে তাদের অর্থ ও অস্ত্রবল সীমিত হওয়ায়– প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ কিনতে তৃণমূল পর্যায় থেকেই এর অর্থায়ন করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠা তৃণমূলের এই নেটওয়ার্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে দিনে দিনে প্রচণ্ড রূপ নিতে থাকা এই গৃহযুদ্ধে।
কো তুত জানান, বেশ কয়েকবারই এসব ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করেছেন। কিন্তু, 'মিয়ানমারে পরিস্থিতির দিন দিন আরো অবনতি হচ্ছে'- উল্লেখ করে বলেন, এই অবস্থায় জান্তা-বিরোধী সংগ্রামকে সমর্থন দেওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে চান তিনি।
তার মতে, 'গেমটি বেশ সম্ভাবনাময়' এবং এক পর্যায়ে মাসে ১০ লাখ ডলার এর মাধ্যমে আয় করা সম্ভব হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন।
'মিয়ানমারের জনতার আজ নিদারুণভাবে সহায়তার দরকার, আমার আশা এই অর্থ তাদের সাহায্য করবে'- তিনি যোগ করেন।
অর্থসংবাদ/এমআই