পশু জবাই শুদ্ধ হওয়ার জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে :
১. গলার নির্দিষ্ট রগসমূহ কাটার মাধ্যমে জবাই হওয়া,
২. জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ পড়া,
৩. জবাইকারী জবাইয়ের উপযুক্ত হওয়া। অর্থাৎ জবাইকারী প্রাপ্তবয়ষ্ক বোধসম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি মুসলিম বা আহলে কিতাব হতে হবে। মুসলিমের সঙ্গে আহলে কিতাব তথা ইহুদি বা মুসা (আ.) ও তাঁর ওপর অবতীর্ণ কিতাব তাওরাতে বিশ্বাসী এবং নাসারা তথা ঈসা (আ.) ও তাঁর কিতাব ইনজিলে বিশ্বাসীদের জবাইকৃত পশুও হালাল হবে। কেননা আহলে কিতাবও আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবাই করাকে নিষিদ্ধ বিশ্বাস করে। (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৫, সুরা : আনআম, আয়াত : ১২১, আবু দাউদ, হাদিস : ২৮২৬, মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক, হাদিস : ৮৫৪৮)
আহলে কিতাবের জবাই হালাল হওয়ার জন্য অপরিহার্য শর্ত
আহলে কিতাবদের জবাইকৃত পশু হালাল হওয়ার জন্য অপরিহার্য শর্ত হলো, আহলে কিতাব তথা ইহুদি-নাসারারা তাদের নিজ নিজ ধর্মের মূলনীতিতে বিশ্বাসী হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা, মুসা (আ.) ও ঈসা (আ.) এবং তাঁদের ওপর অবতীর্ণ কিতাব তাওরাত-ইনজিলের ওপর সামগ্রিকভাবে বিশ্বাসী হতে হবে। শুধু আদমশুমারি ও জন্মসূত্রে ইহুদি-নাসারা হয়ে বিশ্বাসের দিক দিয়ে নাস্তিক হলে চলবে না। বর্তমানে ইহুদিদের মধ্যে সাধারণত স্বধর্মে বিশ্বাসী থাকলেও নাসারাদের একটি বিশাল অংশ আদমশুমারি ও জন্মসূত্রে নাসারা হলেও বিশ্বাসের দিক দিয়ে স্বঘোষিত নাস্তিক। এই নাস্তিকদের জবাইও মুশরিকদের মতো হারাম। (জাওয়াহিরুল ফিকহ ৬/২০০-২১৬)
জবাইবিষয়ক অজ্ঞাত গোশতের বিধান
যদি পশু জবাইকারীর বিশ্বাস ও জবাই শরিয়তমতে হয়েছে কি না তা জানা না থাকে, তাহলে এর বৈধতা-অবৈধতার বিষয়ে ব্যাখ্যা আছে :
এক : মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার গোশত নির্দ্বিধায় খাওয়া হালাল, যদিও জবাই শরিয়তমতে হয়েছে কি না তা জানা নেই। কেননা ইসলামে মুসলিমদের ওপর সুধারণার নির্দেশ রয়েছে। বিশুদ্ধ হাদিসে এসেছে যে একদল লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলল, অনেক নওমুসলিম আমাদের কাছে গোশত নিয়ে আসে। আমরা জানি না যে পশু জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ বলা হয়েছিল কি না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা বিসমিল্লাহ পড়ে খেয়ে নাও। (বুখারি, হাদিস : ৫৫০৭, ৭৩৯৮)
্রওই হাদিসে নওমুসলিমদের জবাইকৃত পশু নির্দ্বিধায় খাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তাই মুসলিম এলাকায় জবাইকৃত পশুর ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত না হবে যে তা অবৈধ পন্থায় জবাই হয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সন্দেহ পোষণ না করে নির্দ্বিধায় গোশত খাওয়া হালাল।
দুই : মুশরিক বা নাস্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার গোশতের ব্যাপারে যতক্ষণ নিশ্চিত না হবে যে তা কোনো মুসলিম বা আহলে কিতাব জবাই করেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত হালাল হবে না।
তিন : মুসলিম, আহলে কিতাব, মুশরিক ও নাস্তিক প্রায় সমহারে মিশ্রিত এলাকার বিধানও দুই নম্বর প্রকারের মতো হবে। অর্থাৎ যতক্ষণ নিশ্চিত না হবে যে তা কোনো মুসলিম বা আহলে কিতাব জবাই করেছে ততক্ষণ পর্যন্ত হালাল হবে না।
চার : আহলে কিতাব তথা ইহুদি-নাসারা অধ্যুষিত এলাকার জবাইকৃত পশুর বিধান মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার বিধানের মতো হালাল। তবে যদি তদন্তের আলোকে এ কথা নিশ্চিত বা প্রবল ধারণামতে জানা যায় যে তারা সঠিক পদ্ধতিতে সাধারণত জবাই করে না, তাহলে জবাইয়ের বৈধতা সুনির্দিষ্টভাবে নিশ্চিত হওয়ার পূর্বে তাদের ওপর সুধারণাবশত গোশত খাওয়া হালাল হবে না। বর্তমানে পশ্চিমা দেশ থেকে আমদানীকৃত গোশতের বিধান এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। (বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যা মুআসারা ২/৩৯-৪১)
অমুসলিম দেশ থেকে আমদানীকৃত গোশতের বিধান
বর্তমানে মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টনা, ডেনমার্ক, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশ জবাইকৃত প্রাণীর গোশত রপ্তানি করে থাকে। এর প্রস্তুতকরণ ও প্রক্রিয়াকরণে বড় বড় ফ্যক্টরি রয়েছে, যাতে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে গরু, বকরি ও মুরগির গোশত রপ্তানি করা হয়। এগুলোর বিধান হলো মুসলিম দেশ থেকে আমদানীকৃত গোশত হালাল।
বাকি রইল অমুসলিম দেশ থেকে আমদানীকৃত গোশতের বিধান। উল্লিখিত বিস্তারিত আলোচনার দ্বারা অমুসলিম দেশের বিধানও সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। কারণ মুশরিক বা নাস্তিক অধ্যুষিত দেশ থেকে আমদানীকৃত গোশত হারাম। আর আহলে কিতাব কাফির অধ্যুষিত দেশ থেকে আমদানীকৃত গোশতের বিধান হলো নির্দিষ্ট গোশতের ব্যাপারে শরিয়তসম্মত জবাইয়ের বৈধতা নিশ্চিত হওয়ার আগে কেবলমাত্র তাদের ওপর সুধারণাবশত গোশত হালাল হবে না। কেননা আরব-আজমের অনেক মুফতি ও ফকিহদের কমিটি স্বচক্ষে দেখা এবং গোশত রপ্তানিকারক কম্পানির সঙ্গে আলোচনা ও তদন্ত সাপেক্ষে এ কথা নিশ্চিত হয়েছেন যে বর্তমানে অমুসলিম দেশ থেকে আগত গোশত বৈধ পন্থায় জবাইকৃত নয় এবং এগুলোতে জবাই শুদ্ধ হওয়ার অপরিহার্য শর্তের তোয়াক্কা করা হয় না।
তাই অমুসলিম দেশ থেকে আমদানীকৃত গোশতের প্যাকেটে ‘হালাল’ অথবা ‘ইসলামী পন্থায় জবাইকৃত’ লেখা থাকলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা শুধু অমুসলিমের সাক্ষীর আলোকে বৈধতা প্রমাণিত হয় না। কারণ হালাল-হারাম বিষয়ক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অমুসলিমের সাক্ষী অগ্রহণযোগ্য। অতএব, অমুসলিম দেশ থেকে আমদানীকৃত গোশতের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য মুফতিদের কমিটির তত্ত্বাবধানে তদন্তসাপেক্ষে এ কথা নিশ্চিত হওয়ার পরই যে শরিয়তসম্মত জবাই হয়েছে—সুনির্দিষ্টভাবে সেগুলো হালাল বলা যাবে। (বুহুস ফি কাজায়া ফিকহিয়্যা মুআসারা ২/৫৭-৯০, ক্বরারু হাইআতি কিবারিল উলামা ৪২-৬৭)
মুফতি মাহমুদ হাসান
লেখক : ফতোয়া গবেষক, ইসলামিক
রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা।