আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখী হয়ে উঠেছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম। এরই মধ্যে পণ্যটির মূল্য নেমে এসেছে এক বছরের সর্বনিম্নে। বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের কারণে এর মূল্য কমছে বলে বাজার বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা অব্যাহত থাকলেও এবারই প্রথম বড় দরপতন হলো। এ দর আরো নিম্নমুখী হওয়ার কথা জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রতিবেদন লেখার সময় গতকাল জ্বালানি তেলের মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) কেনাবেচা হচ্ছিল প্রতি ব্যারেল ৬৮ ডলার ৮১ সেন্টে। আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের মূল্য ছিল ৭৩ ডলার ৪২ সেন্ট। এর আগে দিনব্যাপী লেনদেনের এক পর্যায়ে ডব্লিউটিআইয়ের দাম নেমে এসেছিল ৬৮ ডলার ৬ সেন্টে, যা এক বছরে সর্বনিম্ন। একইভাবে ব্রেন্টের দামও এক পর্যায়ে গত ১২ মাসের সর্বনিম্নে ৭২ ডলার ৪৫ সেন্টে নেমে এসেছিল। এক সপ্তাহ আগেও অর্থাৎ ৭ ডিসেম্বর ডব্লিউটিআইয়ের সর্বনিম্ন বাজারদর ছিল ৭০ ডলার ৩৫ সেন্ট। আর ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৭৫ ডলার ১৮ সেন্ট ছিল।
কভিড-পরবর্তী সময় ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা শুরু হয়। এক পর্যায়ে দর ঊর্ধ্বমুখী থাকায় ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১৩০ ডলারের কাছাকাছি চলে যায়। তথ্যসেবা ও পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে ডব্লিউটিআইয়ের গড় মূল্য গত অক্টোবর পর্যন্ত ছিল ৭৮ ডলার ২২ সেন্ট আর ব্রেন্টের ৮২ ডলার ৭৯ সেন্ট।
এদিকে বিশ্ববাজারে ব্যাপক হারে দরপতন হলেও দেশে এখনই তা সমন্বয় হচ্ছে না বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনকারী সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) দায়িত্বশীলরা। বিষয়টি এখন কেবল পর্যবেক্ষণ করা হবে বলে জানান তারা। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বরাবরই অস্থিতিশীল। নিম্নমুখী দাম থাকলে কখন এটি ঊর্ধ্বমুখী হবে সেটি বলা যাবে না। ফলে কয়েক মাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যা বিপিসি সার্বক্ষণিক করছে। এ সময় দাম স্থিতিশীল থাকলে জ্বালানি বিভাগকে অবহিত করা হবে। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্থিতিশীল থাকলেও বিপিসি ২০২২-২৩ অর্থবছরে কর-পূর্ববর্তী মোট মুনাফা করে ৬ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আর কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এ সময় সরকারি কোষাগারে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, লভ্যাংশ, আয়করসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে বিপিসি। যদিও বিশ্ববাজারের নিম্নমুখিতার মধ্যেই গত বছরের মাঝামাঝি সময় লোকসানের কথা বলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। ওই বছরের আগস্টে ডিজেল-কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রলের রেকর্ড দাম বাড়ানো হয়। অর্থাৎ ৮০ টাকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি করা হয় ১০৯ টাকা, পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২৫ এবং অকটেন ৮৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ১৩০ টাকা। বিপিসি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের প্রভাব ছিল জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও তার সুফল দেশের ভোক্তা খুব বেশি পাবে না বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। অথচ মূল্যবৃদ্ধির সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে দাম কমলে পরবর্তী সময়ে তা সমন্বয় করা হবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘বিশ্ববাজারে উচ্চমুখী দাম থাকা সত্ত্বেও বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করেছে। দেশে মানুষ যখন ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির বিপুল অংকের এ মুনাফা সরকারের জ্বালানি তেল বিক্রিতে লাভ করার মনোপলি সিদ্ধান্ত।’
আগামী মার্চ কিংবা এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে সম্প্রতি জানিয়েছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ বিষয়ে অধ্যাপক ম. তামিম অবশ্য বলেন, ‘এটার সুফল জনগণ খুব বেশি পাবে না। পেট্রলের ক্ষেত্রে এটা হতে পারে। অন্য জ্বালানি সমন্বয় করা হলেও তা খুব বেশি কার্যকর হবে না।’ জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়ে বরং বিপিসি তার মুনাফা দিয়ে অন্তত একটা দীর্ঘ সময়ব্যাপী মূল্য সমন্বয়ের কাজ করতে পারত বলে মনে করেন এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। কিন্তু সেটি তারা করেনি।
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয় উৎস থেকে। বাকি পুরোটাই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। গতকালও সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত মিলিয়ে মোট ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত এবং সিঙ্গাপুর থেকে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আসবে। এতে মোট ব্যয় হবে ২৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।