সম্প্রতি খুলনা বিভাগের দুটি জেলার চার উপজেলার ২৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর করা এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার (২৪ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে জাতীয় নীতি সংলাপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষায় পাঠদান, শিখন এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় ঘাটতি’ নামে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন খুলনার বটিয়াঘাটা ও দাকোপ এবং বাগেরহাটের মোংলা ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার ৮০৪ জন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। গবেষণায় প্রাথমিক শিক্ষায় পাঠদান, শিখন এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এবং ঘাটতি বিষয়ে বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গবেষণার অন্তর্ভুক্ত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ নিজ উদ্যোগে কোচিং করে। স্কুলশিক্ষকের কাছে কোচিং বা টিউশন নেয় ২৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে আলাদা কোচিং নেয়। স্কুল থেকে কোচিংয়ের জন্য গড়ে ৩৬৭ টাকা, নিজ উদ্যোগে করা কোচিংয়ের জন্য ৮৩৪ টাকা, স্কুলশিক্ষকের কাছে কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনের জন্য মাসে ৫২১ টাকা ব্যয় করতে হয় শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের। এছাড়াও এ শিক্ষাস্তরের ১ দশমিক ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে দেওয়া গাইড বই ব্যবহার করে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাইভেট টিউশন ও গাইড নির্ভরতা বেড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জরুরি আশ্রয়ের কারণে পাঠের সময় নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও শিক্ষার মান এখনো একটি চ্যালেঞ্জ।
গবেষণায় কয়েকটি নীতি সংক্রান্ত সুপারিশ করা হয় তা হলো- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শূন্য পদে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং দুর্যোগপ্রবণ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় মনোযোগ দিতে হবে।
নীতি সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে তবে গুণগত শিক্ষায় আমরা এখনো পিছিয়ে আছি এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ ৭টি পক্ষ রয়েছে। এই পক্ষগুলোর সমন্বয়ের দুর্বলতা গুণগত মান অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গুণগত মান অর্জনে পিছিয়ে থাকায় আমরা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও যোগ্য মানুষকে সবসময় খুঁজে পাই না।
তিনি বলেন, শিক্ষকদের দুর্যোগকালীন বা বিভিন্ন সময় স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। ফলে তাদের মূল শিক্ষামূলক কাজটিই ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে কাজটি করানো যায়। দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে আগে প্রায়োরিটি ঠিক করতে হবে তারপর পলিসি মেকিং করতে হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ একেবারেই কম। অভিভাবককে অর্থ ব্যয় করে এটি চালিয়ে নিতে হচ্ছে। পরিবারের আয়ের একটা বড় অংশ শিক্ষায় ব্যয় হচ্ছে। আমরা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও যদি ব্যর্থ হই, তাহলে শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কারণ, এর আগে আমরা সৃজনশীল পদ্ধতি করেছিলাম, তা বাদ দিতে দশ বছর সময় লেগেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রঞ্জন সাহা পার্থ বলেন, আমাদের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। যখন দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন সরকার মোবাইলে এসএমএস (খুদে বার্তা) এর মাধ্যমে জনগণকে সতর্ক করতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- যাদের জন্য এই সতর্কবার্তা, সেই দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় তিন দিন আগে থেকে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে তারা সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে খুদে বার্তা পাঠাচ্ছি, সেগুলো কার কাছে পাঠাচ্ছি? এটা কি অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে কিনা, এই বিষয়টি একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায়।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (কার্যক্রম) ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ। গবেষণার আলোকে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুজিবন্ডের লিড গবেষক শাহজাদা এম আকরাম। গবেষণার ওপরে আলোচনা করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ফেলো সিবান শাহানা এবং স্ট্রিট চাইল্ড ইউকে’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইমতিয়াজ হৃদয়। সংলাপ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশন এর সুশাসন, অধিকার ও ন্যায্যতা কর্মসূচির উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমা।
এমআই