হেমন্তের মৌনতা ছাপিয়ে মেতে উঠি নবান্ন উৎসবে

হেমন্তের মৌনতা ছাপিয়ে মেতে উঠি নবান্ন উৎসবে
দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। পাকা ধানের সোনালি আবরণে সজ্জিত। সোনালি এই আবরণ শুধু প্রকৃতিকে নয়, কৃষকের মনকেও আন্দোলিত করেছে। মাঠজুড়ে সোনালি ধান। কৃষকের সোনালি স্বপ্ন। বেঁচে থাকার, টিকে থাকার স্বপ্ন।

সকালের মিষ্টি সোনারোদ শিশিরসিক্ত ধানেরছড়ায় পড়ে যেন সোনার বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে।ফসলের ক্ষেতজুড়ে পাকা ধানের ম ম গন্ধে চারপাশে ছড়িয়েছে মাদকতা। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় পরিপক্ক ধানের ছড়াগুলোর অল্প অল্প দোল খাওয়া দেখে কৃষকের উন্মুখ মন এক অপার সুখের পরশে সিক্ত হচ্ছে। গ্রামবাংলা যেন হয়ে উঠেছে এক সোনালি শস্যভান্ডার! কৃষকের মুখে অনাবিল সুখের হাসি।

এইতো আর কিছুদিন পরেই শুরু হবে ধান কাটা, মাড়াই আর ঘরে তোলার মহোৎসব। কৃষকের আঙিনা ভরে যাবে সোনালি ধানে। গোলাভরা সোনালি ধান, কৃষকের সোনালি স্বপ্ন। মরা কার্তিকের অভাব-দুঃখ-কষ্ট ভুলে নবান্ন উৎসবে মেতে উঠবে কৃষাণপরিবার। উৎসবের আমেজে হেসে উঠবে জরাজীর্ণ মুখগুলো। নবান্ন উৎসব কৃষকপরিবারের প্রকৃত ‘ঈদ উৎসব’।



প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই শরতের শুভ্র মেঘের ভেলায় চড়ে হেমন্ত আসে। তবে সে একা আসে না। কুয়াশার চাদর মুড়ে শীতের পরশ গায়ে মেখেই প্রকৃতিতে তার আবির্ভাব ঘটে। তাই হেমন্তের প্রকৃতিজুড়েই দেখা যায় শীত-শরতের মাখামাখি। হেমন্তকে বলা হয় অনুভবের ঋতু। কারণ হেমন্তকে আলাদাভাবে দেখা যায় না। আলাদাভাবে এর স্বাদ গন্ধ নেওয়া যায় না।অন্যান্য ঋতুর তুলনায় হেমন্ত অনেকটাই ম্লান, ধূসর ও অস্পষ্ট।

হেমন্তের শিশিরস্নাত সকাল শুরু হয় কচি লাউয়ের ডগায় সোনামুখো রোদের ঝিলিক দেখে।দুপুরে মিষ্টি নরম রোদের খেলা।মায়াময় বিকেলে ডানপিঠে ছেলেদের গোল্লাছুট, ঘুড়ি উড়াউড়ি আরো কত কি! সন্ধ্যায় বাঁশ ঝাড়ের শিরশির ধ্বনি তারই মাঝে নীড়ে ফেরা পাখিদের কলকাকলি, রাতের মেঘমুক্ত অাকাশে জ্যোৎস্নার মুক্তঝরা হাসিতে গ্রামীন পথ-ঘাট, বন- বাদাড় উদ্ভাসিত।এরই মাঝে নিশুতি পাখিদের বিচরণ আর বিচিত্র শব্দরাজিতে গা ছমছমে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে। রাতের শেষদিকে মৃদু কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে অাসে প্রকৃতি।শীতল পরশে শিহরিত হয় জনজীবন।এ যেন শীতেরই পূর্বাভাস।হেমন্তের এই এক অপূর্ব মায়ায় জনজীবন জড়িয়ে পড়ে।



হেমন্তকে সাজাতে প্রকৃতিতে ফুটে জুঁই, গোলাপ, শাপলা, গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, ছাতিমসহ অনেক নাম জানা-অজানা ফুল।এই সময় বহু দূর-দূরান্ত থেকে শীতের অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করে একটু উষ্ণতার জন্য বাংলাদেশের ছোটবড় হাওর-বিল-জলাশয় আর দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরে।প্রকৃতিতে চলে শীতের অাগমনী বার্তা। গাছিরা খেজুর রস সংগ্রহের প্রাথমিক ধাপ গাছ পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত।এ সময় গাছের পাতা ঝরতে শুরু করে।এই জন্য হেমন্তকে পাতা ঝরার ঋতুও বলা হয়।

হেমন্তের শুরুটা হয় শরতের বৈশিষ্ট্য দিয়ে শেষ হয় শীতের পরশ মেখে। তাই হেমন্ত শরত থেকে পৃথক নয় আবার শীত থেকেও বিচ্ছিন্ন নয়।

“কার্তিক” ও “অগ্রহায়ণ” এই দুমাসের সমন্বয়ে হেমন্তকাল। শরতে যে আমনের চারা রোপন করা হয় তা কার্তিকে এসে বাড়তে থাকে।এই সময় কৃষকের ঘরে ফসলের মজুদ ফুরিয়ে যায়।দেখা দেয় অভাব অনটন।অগ্রহায়ণে সেই ধান পরিপক্ক হয়। হলুদ ধানে ভরে যায় মাঠ-ঘাট-প্রান্তর।অগ্রহায়ণ মাস ফসল তোলার মাস।ধান কাটা, মাড়াই, গোলায় তোলা, রাতভর উনুনে সিদ্ধ করা, শুকানো, ঢেঁকি বা কলে সেই ধান ভেঙ্গে নতুন চাল বের করানো কত কি করতে হয়! তারপরই তো সবাই মেতে উঠে সর্বজনীন উৎসব ‘নবান্নে’।

 



হেমন্তের মৌনতাকে ছাপিয়ে নবান্ন অাসে সর্বজনীন উৎসবের ছোঁয়া নিয়ে।গৃহস্থবাড়িতে চলে নতুন চালের ফিরনি-পায়েশ, পিঠাফুলির উৎসব।তৈরি করা হয় মুড়ি-মুড়কি।অাত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি সবাইকে নিয়ে চলে এই উৎসব।মেয়েকে বাপের বাড়িতে নাইওর অানা হয়।জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়।রাত বিরাতে বসে বাউল গানের অাসর।কোথাও কোথাও গ্রাম্যমেলারও আয়োজন করা হয়।এগুলো গ্রামবাংলার চিরচেনা রুপ, চিরচেনা ঐতিহ্য।মূলত হেমন্তের নবান্নকে ঘিরেই গ্রামবাংলা যেন নতুনভাবে উজ্জ্বীবিত হয়।

শুধু কি গ্রাম! শহরবাসীও নবান্নে উৎসবে-আনন্দে মাতোয়ারা হয়।চলে পিঠাউৎসব। আর সন্ধ্যায় বিভিন্ন সংগঠনের সাংস্কৃতিক আয়োজন।এসবের মধ্য দিয়েই শহরবাসী নবান্নকে বরণ করে নেয়।

নবান্ন সর্বজনীন উৎসব হলেও ছিন্নমূল-হতদরিদ্রমানুষগুলো এর ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। অবস্থাসম্পন্ন মানুষগুলো একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই উৎসব-আনন্দে তারাও মেতে উঠতে পারে।

সর্বোপরি, “নবান্ন” সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে হয়ে উঠুক সর্বজনীন ‘লোকজ উৎসব।’

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী আজ
জাপানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জাপানি চিত্রকলা বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান
সোহেল মাহমুদের থ্রিলার-উপন্যাস ‘অ-নির্বাণ’
একুশে বইমেলায় আলতামিশ নাবিলের 'অস্কারনামা'
‘কাব্যরাগে অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের মোড়ক উম্মোচন
বইমেলায় আলতামিশ নাবিলের 'বাংলার চলচ্চিত্রপাঠ'
বইমেলায় রাশেদুল মওলার ‘লকডাউনের লকারে’
বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে জহিরুল ইসলামের ‘এভিয়েশন ক্যারিয়ার’
একুশে বইমেলায় জান্নাতুল ফেরদাউস অনির ‘সরল অঙ্ক’