এক দশক আগেও প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা পুরোটাই মেটানো হতো আমদানি দিয়ে। বছর দশেকের ব্যবধানে দেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ন। স্থানীয় প্রয়োজন মিটিয়ে হচ্ছে রপ্তানিও। হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যেতো দেশের বাইরে। আজ তা যাচ্ছে না, উল্টো আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ যেন এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশের রূপকল্প। এ যেন এক হিরন্ময় বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
ওয়ালটনের এই সাফল্য বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের জন্য একটি জলন্ত উদাহরণ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের রোড ম্যাপ সামনে রেখে ওয়ালটনের মতো দেশের বেসরকারি খাতগুলো জেগে উঠলে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন আর অধরা নয়। বাস্ববতার নিরিখেই ওয়ালটন স্বপ্ন দেখাচ্ছে উন্নত বাংলাদেশের।
রাজধানী ঢাকা থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গাজীপুরের চন্দ্রায় ৭৫০ একরেরও বেশি জায়গায় গড়ে উঠেছে ওয়ালটনের সুবিশাল সুদৃশ্য কারখানা। নিজস্ব কারখানায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি হচ্ছে রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার, কম্প্রেসর, টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স, ইলেকট্রিকাল অ্যাপ্ল্যায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সলিউশনস, হার্ডওয়্যার, এলিভেটরসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য। বর্তমানে পণ্য বৈচিত্র্যের দিকে জোর দিচ্ছে ওয়ালটন। সম্ভাব্য নানামুখী প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় একের পর এক প্রকৌশল পণ্য বাজারে নিয়ে আসছে নিখাদ এই বাংলাদেশী ব্র্যান্ড। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের ৪০ টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে ওয়ালটন পণ্য।
ওয়ালটন গ্রুপে রয়েছে বেশকিছু স্বনামধন্য সফল প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ওয়ালটন মাইক্রোটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ওয়ালটন ডিজিটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ওয়ালটন শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিক, মার্সেল এন্টারপ্রাইজ, নাসদাত ইউটিএস ল্যাব অন্যতম।
প্রকৃতপক্ষে, ওয়ালটন উদ্যোগের শুরু ১৯৭৭ সালে। তখন রেজভী এন্ড ব্রাদার্স নামে ব্যবসা শুরু করেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মরহুম এস এম নজরুল ইসলাম। যা পরবর্তীতে ওয়ালটন গ্রুপ নামকরণ হয়। আগের ব্যবসায়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে সিআই শিট আমদানি এবং পণ্য উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে ইলেকট্রনিক্স এবং ইলেকট্রিক্যাল পণ্যের ট্রেডিং শুরু হয়। তখন উদ্যোক্তারা ট্রাইকন নামে নতুন ব্র্যান্ড চালু করেন। ১৯৯৭ সালের ২০ মার্চ ওয়ালটন ব্র্যান্ডের যাত্রা শুরু। ২০০১ সালে আরবি গ্রুপ বা রেজভি এ্যান্ড ব্র্রাদার্সের রেজিস্ট্রেশন হয় গ্রুপ অব কোম্পানি হিসেবে। ২০০৬ সালে গাজীপুরের চন্দ্রায় শুরু হয় বৃহৎ পরিসরে ওয়ালটন কারখানা স্থাপনের কাজ। ২০০৮ সালে শুরু হয় উৎপাদন। ২০১০ সালে যুক্ত হয় টিভি এবং হোম এ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদন। এরপর এয়ারকান্ডিশনার এবং ২০১৭ সালে শুরু হয় কম্প্রেসর উৎপাদন। এর পরের বছর ২০১৮ সালে নিজস্ব কারখানায় মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপ তৈরি শুরু করে ওয়ালটন। ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে শুরু হয় শেয়ার বাজারে ওয়ালটনের লেনদেন। বর্তমানে একক বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিনিয়োগের দিক দিয়ে শীর্ষে ওয়ালটন। যেখানেই ওয়ালটন হাত দিচ্ছে, সোনা ফলছে সেখানেই। আর তাতেই একের পর এক ইতিহাস সৃষ্টি করে যাচ্ছে ওয়ালটন।
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এস এম নজরুল ইসলামের সুযোগ্য পাঁচ ছেলে বর্তমানে সফলতা ও দূরদর্শীতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের ওয়ালটনকে। তাঁরা হলেন এস এম নুরুল আলম রেজভী, এস এম শামছুল আলম, এস এম আশরাফুল আলম, এস এম মাহবুবুল আলম এবং এস এম রেজাউল আলম। এই স্বপ্নবান মেধাবীদের বুদ্ধিমত্তায় ওয়ালটন এখন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক উদ্যোগ। তাঁদের দৃষ্টি আরো দূরে- বিশ্বের শীর্ষ ব্র্যান্ড হওয়ার দিকে।
যদিও দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইতিমধ্যেই ওয়ালটন এখন একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড। ‘আমাদের পণ্য’ স্লোগানে ওয়ালটনই প্রথম ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বলার সাহস দেখিয়েছে। সাশ্রয়ী মূল্যে দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের হাতে উচ্চমানসম্পন্ন প্রযুক্তি পণ্য তুলে দিচ্ছে তারা। অবদান রাখছে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে। সেইসঙ্গে মানবিক, আর্থ সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সৃষ্টি করেছে ব্যাপক কর্মসংস্থানের।
ব্যাপকভাবে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করছে ওয়ালটন। দেশের প্রচলিত-অপ্রচলিত সব ধরনের খেলাধুলার উন্নয়নে সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক এখন ওয়ালটন। প্রতি বছর লাভের একটি অংশ সরকারের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে দেয়া হচ্ছে। কর্মীদের মধ্যে বন্টন করা হচ্ছে লভ্যাংশ। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলেও সামর্থ অনুযায়ী অবদান রাখছে ওয়ালটন। শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এতিমখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। বিধবা-বয়স্ক ভাতাসহ দুস্থ ও দরিদ্র মানুষের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা এমনকি আর্থিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডি থেকে করোনাকালে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে ওয়ালটন। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় দেশের প্রায় ৪০০টি ওয়ালটন প্লাজা এবং ১৭০০০ এর বেশি এক্সক্লুসিভ ডিষ্ট্রিবিউটর, ডিলার ও সাব-ডিলারের মাধ্যমে সারাদেশে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ‘আমরা ভেজালমুক্ত খাদ্য চাই’-এর সকল কর্মকান্ডের পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে ওয়ালটন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছে ওয়ালটন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে ২০১৫ সালের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেট লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল ব্র্যান্ড এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০১৪, ডিএইচএল-ডেইলি স্টার বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড-২০১৪। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা শীর্ষ করদাতা ও সেরা প্যাভিলিনসহ মোট ২৭টি পুরস্কার পেয়েছে ওয়ালটন। আমদানি বিকল্প শিল্পে অবদান রাখায় সম্প্রতি মিলেছে এক্সপোর্ট এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণে অবদান রাখায় ২০১৮ সালে পেয়েছে জাতীয় পরিবেশ পদক ২০১৮। ২০২০ সাল পর্যন্ত সাতবার ‘বেস্ট ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে ওয়ালটন রেফ্রিজারেটর। এছাড়া লন্ডনভিত্তিক বহুজাতিক সংস্থা ২০২০ ও ২০২১ সালের জন্য ওয়ালটনকে ‘সুপারব্র্যান্ড’ সম্মাননা দিয়েছে।