সুতরাং একজন মুমিন রজমানের দিনগুলোতে বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করবে, তাকওয়া তথা আল্লাহভীতির জীবনযাপন করবে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে রমজানের চেনাচিত্র বদলে যায় অনেকটাই। গত বছর সারা বিশ্বের মুসলিমরা অবরুদ্ধ রমজান কাটিয়েছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এ বছরও মানুষ ক্রমেই ঘরবন্দি হয়ে পড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে করোনাকালে মুসলিমরা কিভাবে ইবাদত-বন্দেগি করবে?
ইসলাম জীবনকেই অগ্রাধিকার দেয়
ইসলাম জীবন ও বাস্তবতাবিরোধী একরৈখিক, নৃশংস ও নির্মম কোনো ধর্ম নয়; ইসলাম মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ ও মানবপ্রকৃতির অনুকূল জীবনবিধন। বর্তমানে যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাশ ও বিকল্প পদ্ধতিও তাতে আছে। ইসলামী শরিয়তের মূলনীতি হলো যখন মানুষের জীবনরক্ষা ও শরিয়তের বিধান পালনের প্রশ্ন এক হয়, তখন ইসলাম জীবনরক্ষার দিকটিই অগ্রাধিকার দেয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ তার ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং কুফরির জন্য হূদয় উন্মুক্ত রাখলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহর গজব এবং তার জন্য আছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার অন্তর ঈমানে অবিচলিত।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১০৬)
মুমিন অন্তর ব্যথিত হবে
উল্লিখিত আয়াতে দুটি বিষয় লক্ষণীয়—এক. অপারগ হয়ে কুফরির মতো অপরাধ করলেও আল্লাহ ক্ষমা করেন, দুই. অন্তর ঈমানে অবিচল থাকবে। করোনাকালীন সময়ের সঙ্গে যদি আমরা মিলিয়ে বলি, তাহলে বলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার্থে যদি কেউ মসজিদে যেতে না পারেন তবে আল্লাহ তাঁর এই ত্রুটি মার্জনা করবেন। আর তাঁর অন্তর ব্যথিত হলে আল্লাহ তাঁকে আগের মতো প্রতিদান দেবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন ঈমানদার অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন ফেরেশতারা বলেন, হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তখন আল্লাহ বলেন, সে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অথবা তার মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত তার আমলনামায় সেরূপ আমলের সাওয়াব লিখতে থাকো, যেরূপ আমল সে সুস্থ থাকা অবস্থায় করত।’ (মুসনাদে আহমদ)
অপারগ ব্যক্তি কে?
কোনো ব্যক্তি অপারগ কি না তা সে নিজেই নির্ধারণ করবে না; বরং স্বাস্থ্যবিষয়ক কোনো কিছু হলে দ্বিনদার ও আল্লাহভীরু চিকিৎসকরাই ব্যক্তির অবস্থা ও বাস্তবতার আলোকে করণীয় নির্ধারণ করবেন। করোনা বিষয়ে বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম ও অমুসলিম চিকিৎসক এক মত যে প্রয়োজনীয় সতর্কতা, স্বাস্থ্যবিধি ও চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। তবে বাজার ও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মতো জনসমাগমস্থল খোলা রেখে মসজিদের ব্যাপারে আরো বেশি কঠোরতা আরোপ ও আরো বেশি সংকোচন নীতি গ্রহণ করা বাস্তবতা ও ইসলামী শরিয়তের মূলনীতিবিরোধী।
উপায়-উপকরণ গ্রহণ
ইসলাম প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও উপায়-উপকরণ গ্রহণের নিদের্শ দেয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আপনি যখন তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন ও তাদের সঙ্গে নামাজ আদায় করবেন, তখন তাদের একদল যেন তোমাদের সঙ্গে দাঁড়ায় এবং তারা যেন সশস্ত্র থাকে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১০২)
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ রাসুল (সা.)-এর উপস্থিতি সত্ত্বেও যুদ্ধাবস্থার কারণে আল্লাহ সশস্ত্র থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, যা থেকে প্রমাণিত হয়, ভীতির পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও উপকরণ গ্রহণ করাই ইসলামের নির্দেশনা। কারোনাভাইরাসের সংক্রমণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা মানবসভ্যতার জন্য কিছুতেই যুদ্ধের চেয়ে কম ভয়ের নয়।
ইবাদত কিভাবে করব
যারা লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি আরোপের কারণে রমজানের ইবাদত-বন্দেগি নিয়ে চিন্তিত, তাদের সুসংবাদ দিয়ে বলতে চাই, রমজানে যেসব ইবাদত বেশি করার তাগিদ এসেছে তার বেশির ভাগই ব্যক্তিগত। কোনো ব্যক্তি চাইলেই তিনি ঘরোয়া পরিবেশেই তা আদায় করতে পারবেন। নিম্নে রমজানের বিশেষ আমলগুলো তুলে ধরা হলো।
১. তারাবি : রমজানের অন্যতম প্রধান আমল তারাবি। জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করা সুন্নত। বিধি-নিষেধের কারণে পারিবারিকভাবেও তারাবির নামাজের জামাত করা যেতে পারে। আর তা যদি সম্ভব না হয়, তবে একাকী আদায় করা যাবে। কেননা একাধিক সাহাবি তারাবির নামাজ একাকী আদায় করেছেন বলেও প্রমাণিত।
২. তাহাজ্জুদ : তাহাজ্জুদ সারা বছরের আমল। নফল নামাজগুলোর মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের প্রশংসাই কোরআনে করা হয়েছে। রমজান তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কে সহজ করে দেয়। সাহরির আগে বা পরে দুই দুই রাকাত করে তাহাজ্জুদ আদায় করা যেতে পারে।
৩. দোয়া : রমজান মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন। রমজানের শেষ রাতে ও ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয়। সুতরাং এ সময় নিজের, পরিবারের, দেশের ও সব মানুষের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য বেশি বেশি দোয়া করা প্রয়োজন।
৪. তাওবা : রমজানের একটি বিশেষ আমল তাওবা। রমজানের রোজা বান্দাকে গুনাহমুক্ত করে। তাই বেশি বেশি তাওবা করতে হবে।
৫. দান : রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানে বেশি বেশি দান করতেন। সুতরাং মুমিন অন্য মাসের তুলনায় রমজানে বেশি দান করবে।
৬. তিলাওয়াত : রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও জিবরাইল (আ.) পরস্পরকে কোরআন শোনাতেন। এ ক্ষেত্রে ‘য়ুদাররিসু’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা অর্থ ও মর্ম অনুধাবনের তাগিদ দেয়।
৭. শুকরিয়া আদায় : আল্লাহ রমজান ও রমজান মাসে যে কোরআন মুসলিম উম্মাহকে দান করেছেন তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা।
৮. অন্যের কষ্ট অনুধাবন : মুমিন রোজা রাখার মাধ্যমে ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট অনুধাবন করতে পারে। তাই সে প্রতিবেশী ও অসহায় মানুষের খোঁজ-খবর রাখে। বিশেষত করোনাকালে কাজ হারানো লোকদের পাশে থাকা প্রয়োজন।
৯. সহজতা অবলম্বন : পূর্ববর্তী উম্মতের তুলনায় আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মদিকে রোজা পালনে সহজতা দিয়েছেন। যেমন সাহরি খাওয়ার অবকাশ দান। তাই রমজানে জীবনযাত্রাকে সহজ রাখা এবং বিলাসিতা পরিহার করা আবশ্যক।
১০. পাপ পরিহার : হাদিসে রোজাদারকে মিথ্যা, পাপ ও বিবাদ পরিহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মিথ্যা, পাপ ও বিবাদ রোজার মাহাত্ম্য নষ্ট করে।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সূত্র: কালের কণ্ঠ