বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। আশি লক্ষ জনসংখ্যার এই শহরের আয়তন ১৬০.৯৯ বর্গ কিমি। উত্তরে হাটহাজারী ও রাউজান, দক্ষিণে আনোয়ারা, পূর্বে রাউজান ও পটিয়া, পশ্চিমে সীতাকুন্ড ও বঙ্গপোসাগর। কাগজে কলমে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। সর্ববৃহৎ বন্দর থাকার কারণে ঢাকার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর হচ্ছে চট্টগ্রাম। এটি এশিয়ায় ৭ম এবং বিশ্বের ১০ম দ্রুততম ক্রমবর্ধমান শহর। এই শহরটিকেও স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মানদন্ডের আদর্শে পরিণত করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য সম্মত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে দরকার বাস্তব সম্মত সমন্বিত মহাপরিকল্পনা এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন।
সবক্ষেত্রে দূষণের বিষয়টি নতুন না হলেও পরিস্থিতি এখন সঙ্কটে রূপ নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ঢাকা-চট্টগ্রামের বায়ু এবং শব্দ দূষণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। সার্দান ইউনির্ভাসিটি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা রিপোর্টে দূষণের ভয়ানক মাত্রা উঠে এসেছে। বাস্তব সম্মত সমন্বিত পরিকল্পনা এবং তার প্রয়োগের অভাবে দূষণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটের প্রাপ্ত তথ্যে, বর্তমানে বিশ্বের হাজারো শহর সংস্থাটির স্বাস্থ্যসম্মত শহর নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত। এই নেটওয়ার্কের আওতায় শহরগুলোর মেয়র এবং মিউনিসিপ্যালিটি জীবনযাত্রা উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমাদের শহরগুলোতেও মেয়রের পক্ষে সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সাহসের সাথে আন্তরিকতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এতো বিশাল সংখ্যক মানুষের বাস যে শহরে সেটিকে স্বাস্থ্যসম্মত করে গড়তে হলে সমন্বিত মহা-পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসম্মত শহরে পরিণত করার জন্য অন্তত কিছু সমস্যা সমাধানের উপর জোর দিচ্ছেন তারা :
পানি দূষণ: বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব যদিও আগের তুলনায় এখন কম। তবে এখনো বিশুদ্ধ খাবার পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। শহরের চারদিকের যে পানির উৎস রয়েছে সেগুলো একদিকে যেমন দূষিত অন্যদিকে নানা ধরনের রোগ-বালাই ছড়াচ্ছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যার মধ্যে পানিবাহিত নানা রোগ ছাড়াও মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বিস্তার। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,এগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য, প্রয়োজন আশপাশ পরিষ্কার রাখা। শহরের যেখানে ওয়াসার পানি নাই সেখানে আর্সেনিক মুক্ত পানি ব্যবস্থা করা।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: দূষণের সব থেকে বড় উৎস বর্জ্য, আর এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। আবার শহরের মধ্যে উন্নয়নকাজের ফলে সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণও ঠিকমতো করতে পারেনি এ দুই প্রতিষ্ঠান। বর্জ্য অপসারণ ও সংগ্রহের ব্যবস্থা অনেক পুরানো। যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করেন তাদের যেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই, ঠিক তেমনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয় যত্রতত্র। পচনশীল, কঠিন কিংবা নবায়নযোগ্য বর্জ্য আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না।
শব্দ দূষণ: বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা ধরণের নীতিমালা থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ নেই বলে জানান পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। শব্দ দূষণের ফলে মানুষের অসুস্থতা বাড়ছে এবং শ্রবণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পশু-পাখিও। ডব্লিউএইচও-এর মতে, স্বাস্থ্যসম্মত শহর শুধু একটি শহরের স্বাস্থ্যসেবার কাঠামোর উপর নির্ভর করে না বরং পরিবেশের উন্নয়নের অঙ্গীকার এবং এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের আগ্রহ। স্বাস্থ্যসম্মত শহরের এই ধারণা স্বাস্থ্য ও সেবার সমতা নিশ্চিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। আমাদের সেবার অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাথে সাথে সেবার মানসিকতারও উন্নয়ন দরকার।
সবুজ পরিবেশ: শরীরচর্চা বা হাঁটার জন্য সবুজ পরিবেশ যেমন উদ্যান, ফুটপাত থাকার নিয়ম থাকলেও এর ব্যবস্থা খুবই কম। একটি স্বাস্থ্যকর শহর হওয়ার জন্য যা অন্যতম মানদন্ড।
ভেজালমুক্ত খাবার: খাদ্যশৃঙ্খলে ক্ষতিকর পদার্থ ও ভেজালের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা হয় না। ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশে ট্রান্স ফ্যাট বিশ্লেষণ করতে সক্ষম কোনও ল্যাব সুবিধা নেই, খাদ্যপণ্য ট্র্যাক করার কোনও শনাক্তকরণের ব্যবস্থা নেই, সালমনেলা, লিস্টারিয়া এবং ই-কোলাইয়ের মতো জীবাণুগুলোকে পানি ও খাদ্যে প্রবেশ রোধ করার কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেই। দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, ডিম এবং ভোজ্যতেলে ট্রেসেবিলিটিটি নিশ্চিতকরণ ভোক্তাদের খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর মতে- উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক শিশুসহ সারাবিশ্বে খাদ্যজনিত রোগে বছরে প্রায় ২০ লাখ মানুষ মারা যায়। এফএও জানায়, বছরে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ১৫ লাখেরও বেশি খাদ্যে দূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হয় এবং এতে ১ লাখ ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।নিরাপদ খাদ্যের জন্য প্রকৃত খাদ্য লেবেলিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং লেবেলে প্রক্রিয়াজাত খাবারের অতিরিক্ত শর্করা, ট্রান্স ফ্যাট ইত্যাদি সম্পর্কে গ্রাহকদের অবহিত করা উচিত।
বায়ু দূষণ: বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যু ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরির অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ। দূষিত বাতাসের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়। যারফলে হৃদযন্ত্রের অসুখ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুস সংক্রমণ ও ক্যানসারের মতো রোগে ভুগছে মানুষ দূষিত বায়ুর কারণে ঢাকার বাতাসকে অত্যন্ত দূষিত বলে ধরা হয়। বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০১৯’ (এসওজিএ)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ুদূষণে। বিশ্বে বায়ুদূষণে মৃত্যুতে বাংলাদেশ পঞ্চম। পৃথিবীর অন্য দেশগুলো তাদের বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণ রোধে পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে, সেখানে আমরা ব্যর্থ। যে কারণে বায়ুদূষণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন নগরবাসী। প্রথমত পুরানো যানবাহনের প্রাধান্য, দ্বিতীয়ত সমন্বয়হীন অপরিকল্পিতভাবে যখন-তখন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও উন্নয়ন কাজ। তৃতীয়ত শহরের আশপাশের ইটভাটা ও শিল্প-কলকারখানার দূষণ, চতুর্থ হচ্ছে শহরের ভেতরে যে ময়লা আবর্জনা জমে তার কারণে।
আমাদেরকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আইনিভাবে বায়ুদূষণ প্রতিকার ও প্রতিরোধ করতে হলে বায়ুদূষণের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং অন্যদের এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। যানবাহনে ক্যাটালাইটিক কনভার্টর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। ডিজেলের পরিবর্তে সিএনজি গ্যাসের বা বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। টোকেন দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমিয়ে গণপরিবহন ব্যবহারের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করতে হবে। সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ দিতে হবে। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। শিশু স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি এই বায়ুদূষণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সামাজিক মিডিয়ায় শিক্ষামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। একই সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সফল প্রয়োগ একান্তভাবে প্রয়োজন এবং প্রশাসনকেও দায়বদ্বতার মধ্যে আনতে হবে। তবেই আমরা পরিবেশ দূষণ সমস্যার সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো।
যানজটের সামগ্রিক সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র নগর পরিকল্পনা বা যানবাহন প্রকৌশলের মাধ্যমে সম্ভব নয়। কারণ যানজট শুধু রাস্তার সমস্যা নয়, এটি আমাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং নাগরিক অসদাচরণও দায়ী। সরকার, সড়ক প্রকৌশলী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম সকলেরই কাজের ধরন ভিন্ন, কিন্তু লক্ষ্য এক। তাই যানজট সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি লোক নগরে বসবাস করে। ২০৩০ সালে নগরবাসীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে আট কোটির ওপর। নগরায়ণকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। আগামীর বাংলাদেশ হবে নগরীর বাংলাদেশ। তাই পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব নগরায়ন ছাড়া পরিবেশদূষণের মতো ভয়াবহ অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ পাবো না। শুধু সরকারি পদক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব নয়। পরিবেশ রক্ষায় সর্বমহলের সচেতনতাও প্রয়োজন।
বর্তমান অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে অতীতকে ফেরানো সম্ভব নয় ঠিকই, তবে স্বাস্থ্যকর শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সমন্বিত কর্মসূচির লক্ষ্যে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে কাজ করতে পারে। স্বাস্থ্যকর শহর এমন একটি শহর, যা কাঠামোগত ও সামাজিকভাবে উন্নত পরিবেশ তৈরি করবে। তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জবাবদিহিতা। প্রশাসনও আইনের উর্ধে নয়, মহা-পরিকল্পনা বাইরে গেলেই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তবেই স্বাস্থ্যকর শহর হওয়ার মানদÐে বিশ্বের পরিবেশবিষয়ক নেতিবাচকের তালিকা থেকে ইতিবাচকের তালিকায় স্থান পাবে বাংলাদেশ। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা
সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও টেকসই উন্নয়নকর্মী